কাজেই ড্রইং রুমে আবার সবাই চলে আসে। হালকা মেজাজে নতুন করে গল্পটল্পর ফাঁকে একসময় সুশোভনকে ডেকে দক্ষিণ দিকের ব্যালকনিতে নিয়ে যায় মণিকা। বেশ অবাকই হয়েছিল সুশোভন। জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?
হ্যাঁ। আস্তে মাথা হেলিয়ে দেয় মণিকা, তোমার বন্ধুরা আমাদের জন্যে এত জিনিস এনেছে। ওদেরও আমাদের দিক থেকে কিছু প্রেজেন্টেশন দেওয়া দরকার। নইলে খারাপ দেখাবে।
এই ব্যাপারটা আগে মাথায় আসেনি, অথচ আসা উচিত ছিল। সংসারের সব দিকে মণিকার চোখ কান খোলা। বরাবরই সুশোভন লক্ষ করেছে, তার কর্তব্যবোধের তুলনা হয় না। মণিকা সম্বন্ধে রীতিমত কৃতজ্ঞতাই বোধ করল সে। খুব আন্তরিকভাবে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, দেওয়া তো নিশ্চয়ই দরকার। ওদের জন্যে তোমার পছন্দমতো কিছু কিনে এনো।
তুমিই নিয়ে এস না।
দোকানের ভিড়ভাট্টায় আমার যেতে ইচ্ছে করে না। সাফোকেটিং মনে হয়। তুমিই একসময় চলে যেও।
ওরা যেরকম প্রোগ্রাম-ট্রোগ্রাম করেছে তাতে পরে যাবার সময় পাওয়া যাবে। গেলে এখনই যেতে হয়।
‘বেশ তো, গাড়িটা নিয়ে চলে যাও।‘
মণিকা নিজে ড্রাইভ করতে জানে। সুশোভন বলা সত্ত্বেও মণিকা কিন্তু গেল না, দাঁড়িয়েই রইল।
সুশোভন জিজ্ঞেস করল, আর কিছু বলবে? মুখ নামিয়ে দ্বিধান্বিতের মতো মণিকা বলে, ‘মানে—’ বলেই থেমে যায়।
হঠাৎ সুশোভনের মনে পড়ে, ডিডোর্স সম্পর্কে মোটামুটি একটা সিদ্ধান্ত নেবার পর থেকেই আলমারির চাবি নিজের কাছে আর রাখে না মণিকা, সতীশকে দিয়ে সুশোভনের কাছে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে।
দ্রুত নিজের বেডরুমে গিয়ে বালিশের তলা থেকে চাবির গোছাটা এনে মণিকাকে দিতে দিতে সুশোভন বলে, আলমারি থেকে টাকা নিয়ে যাও—
কুণ্ঠিত মুখে মণিকা বলে, ‘কিন্তু—’
বিষণ্ণ হাসে সুশোভন, ‘স্বামী-স্ত্রীর নকল রোলে যখন অভিনয় করতে রাজিই হয়েছ তখন সামান্য খুঁতটা আর রাখছ কেন? ফিউচারে আমাদের যা-ই ঘটুক না, আমি কি তোমাকে কোনওদিন অবিশ্বাস করতে পারব?’ তার কণ্ঠস্বর অদ্ভুত এক কষ্টে বুজে আসে।
মণিকা উত্তর দেয় না। চাবি নিয়ে সোজা সুশোভনের ঘরে গিয়ে আলমারি খোলে। কতকাল বাদে সে এই ঘরে ঢুকল।
একটু পর টাকা নিয়ে একাই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল মণিকা। যাবার আগে পরিমলদের বলল, একটা দরকারি কাজে সে বেরুচ্ছে। ঘন্টাখানেকের ভেতর ফিরে আসবে। ইচ্ছে হলে পরিমলরা একটু ঘুমিয়ে নিতে পারে।
পরিমল জানালো, দুপুরে ঘুমোবার অভ্যাস তার বা সুজাতার কারও নেই। মণিকা যতক্ষণ না ফিরছে তারা সুশোভনের সঙ্গে গল্প করে কাটিয়ে দেবে। সে ফিরে। এলে চারজনে জমিয়ে তাসের আসর বসাবে।
.
এক ঘন্টা না, প্রায় ঘন্টাদুয়েক বাদে সুজাতার জন্য দামি মাইশোর সিল্কের শাড়ি, নামকরা গায়কদের লং-প্লেয়িং রেকর্ড, কিছু ইন্ডিয়ান পারফিউম আর পরিমলের জন্য দামি প্যান্ট এবং শার্টের পীস ইত্যাদি নিয়ে ফিরে এল মণিকা।
পরিমল প্রায় চেঁচামেচিই জুড়ে দিল, এই জন্যে বেরুনো হয়েছিল! কোনও মানে হয়?
সুজাতা মজা করে বলল, ‘ওই যে আমরা কি একটু দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে তার রিটার্ন দেওয়া হল।
মণিকা বলল, রিটার্ন আবার কী! সামান্য উপহার। এগুলো দেখলে আমাদের কথা মনে পড়বে।
পরিমল বলল, এগুলো না দিলেও মনে পড়বে।
‘জানি। তবু—’
এরপর এ নিয়ে আর কথা হয় না। পরিমল বলে, এবার তা হলে তাস নিয়ে বসা যাক।
মণিকা বলে, আমার আপত্তি নেই। পুরুষ ভার্সান মহিলা খেলা হোক। সুজাতা আর আমি একদিকে, আপনার ফ্রেণ্ড আর আপনি আরেক দিকে।
‘ও, নো নো—’ জোরে জোরে প্রবলবেগে মাথা নাড়ল পরিমল, ওটা হবে না। ওই ইভস ভার্সান আদমস-এর কারবারে আমি নেই। সুজাতা আমার লাইফ পার্টনার। সুখে-দুঃখে ভালয়-মন্দয়, চেস্ট বেঙ্গলিতে কী যেন বলে শ্মশানে রাজদ্বারে সব সময় ও আমার পার্টনারই থাকবে। এই তাস খেলাতেও ওকে আর কারও পার্টনার হতে দেব না বলে রগড়ের ভঙ্গিতে চোখ টিপল।
পরিমল এবং সুজাতার মধ্যে সম্পর্কটা কতটা গভীর, নতুন করে আরেক বার টের পাওয়া গেল। সুশোভন একধারে এতক্ষণ চুপচাপ সিগারেট হাতে বসে ছিল। কোনও এক যান্ত্রিক নিয়মেই যেন তার চোখ চলে যায় মণিকার দিকে। মণিকাও তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতেই দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নেয় মণিকা। সুশোভন টের পায়, বুকের অতল থেকে ঢেউয়ের মতো কিছু একটা উঠে আসছে।
একসময় খেলা শুরু হয়। পরিমলের ইচ্ছে মতোই সুজাতা তার পার্টনার হয়েছে। অগত্যা সুশোভনের পার্টনার হয়েছে মণিকা।
সুজাতা ভুল তাস ফেললেই হই চই করে একটা কাণ্ড বাধিয়ে দিচ্ছে পরিমল, তুমিই আমাকে ডোবাবে।
মণিকা খুব ভাল তাস খেলতে জানে না। সে এনতার বাজে তাস ফেলে যাচ্ছে। আগেকার সম্পর্ক থাকলে পরিমলের মতোই সুশোভনও চেঁচামেচি করত। কিন্তু হারজিত্রে ব্যাপারে এখন তার মনোভাব একেবারেই নিস্পৃহ। প্রতি দানেই তারা পরিমলদের কাছে হেরে যাচ্ছে। কিন্তু কী আর করা যাবে। জয় পরাজয়, দুইই তার কাছে এখন সমান। নিঃশব্দে অন্যমনস্কর মতো সে খেলে যেতে লাগল।
প্রতি দানে জিতে জিতে দারুণ মেজাজে আছে পরিমল। সে বলল, কি রে, তোর বউ তোকে ফিনিশ করে দিলে!
চমকে মণিকার দিকে তাকায় সুশোভন। চমকানো ভাবটা তার একার নয়, মণিকারও। দ্রুত মণিকা তার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল।