সুজাতা হাসল।
‘তুমি করে বললে রাগ করবে না তো?’ মণিকা ফের বলে।
‘আরে না না, তুমি করেই তো বলবে।’ মণিকা যে এত দ্রুত আপন করে নেবে সুজাতা ভাবতে পারেনি। তাকে খুবই খুশি দেখাল।
বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চোখের কোণ দিয়ে মণিকাকে লক্ষ করতে লাগল সুশোভন। হেসে হেসে সুজাতার সঙ্গে গল্প করছে মণিকা। খুবই ইনট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে সে। কোনওদিন তাকে এত উচ্ছ্বসিত হতে দেখেনি সুশোভন। যেভাবে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে সুজাতার সঙ্গে সে কথা বলছে তাতে মনে হয় সুজাতা যেন তার কতকালের চেনা। মণিকার সঙ্গে তার সম্পর্কটা যে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এই মুহূর্তে তাকে দেখলে কে তা বুঝবে!
কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে সতীশকে দিয়ে প্রচুর কেক, প্যাস্ট্রি, সন্দেশ আর চা নিয়ে নিজের হাতে সাজিয়ে সবার সামনে ধরে দিল মণিকা। তারপর বাজার থেকে কী কী আনতে হবে, তার একটা লিস্ট করে তাকে পাঠিয়ে দিল। প্রায় দেড়মাস বাদে এভাবে তাকে বাজারে পাঠাল মণিকা। এই ক’সপ্তাহ সতীশ নিজের থেকেই যা ইচ্ছে কিনে এনেছে বা বেঁধেছে। কিভাবে কি হচ্ছে, সে সম্পর্ক একটা কথাও বলেনি মণিকা। এমন কি রান্নাঘরে উঁকি পর্যন্ত দেয়নি। গভীর উদাসীনতায় সংসার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থেকেছে। সতীশও সুশোভনের মতোই অবাক হয়ে গেছে। বিমূঢ়ের মতো মণিকাকে দেখতে দেখতে সে চলে গেল।
এদিকে আচমকা কিছু মনে পড়ে যেতে পরিমল স্ত্রীর দিকে ফিরে বলল, ওদের জন্যে কী সব এনেছ, সেগুলো বার করে দাও।
‘আরে তাই তো—’ ব্যক্তভাবে নিজেদের সুটকেসটা খুলে সুশোভনের জন্য দামি প্যান্টের পিস, টাই-পিন, টেপ-রেকর্ডার এবং মণিকার জন্য ফরেন কসমেটিকস, হাউস কোট ইত্যাদি ইত্যাদি কত রকমের জিনিস যে বার করে দিল সুজাতা!
সুশোভন বলল, ‘এত সব কী এনেছিস! তোদের কি মাথা-টাথা খারাপ!’
সুজাতা এবং পরিমল একসঙ্গে জানালো, এমন কিছুই তারা আনেনি। খুবই সামান্য জিনিস।
হাত পেতে হাউস কোট-টোট নিতে নিতে ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যাচ্ছিল মণিকা। এসব তাকে নিতে হচ্ছে সুশোভনের স্ত্রী হিসেবে, যার সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যেই তার সম্পর্ক চিরদিনের মতে ছিন্ন হয়ে যাবে। এই উপহারগুলিতে তার এতটুকু অধিকার নেই। এক ধরনের ক্লেশ এবং অস্বস্তি মণিকাকে খুবই কষ্ট দিতে থাকে। মনে মনে সে স্থির করে ফেলে, এলাহাবাদ যাবার সময় এর একটি জিনিসও নিয়ে যাবে না, সব এখানে রেখে যাবে।
মণিকা নিজের মনোভাবটা মুখে চোখে ফুটে উঠতে দেয় না। শুধু বলে, এর কোনও মানে হয়!
ওদের কথাবার্তার মধ্যেই একসময় বাজার করে ফিরে আসে সতীশ। কী কী রান্না হবে, ভাল করে তা বুঝিয়ে দেয় মণিকা। শুধু তা-ই নয়, মাঝে মাঝে গল্পের ফাঁকে ফাঁকে উঠে গিয়ে রান্না দেখিয়ে আসে, কখনও বা চা করে আনে।
অতিথিদের যে এত যত্ন করতে পারে, যে এমন নিপুণ সুগৃহিণী, কদিন পরেই তার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না, ভাবতেই বুকের ভেতর অদৃশ্য কোনও শিরা ছিঁড়ে যায় সুশোভনের।
.
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার সময় অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটে যায়। টেবিলের এক দিকে পাশাপাশি বসেছে পরিমল এবং সুজাতা। তাদের মুখোমুখি মণিকা আর সুশোভন। মণিকা অবশ্য একসঙ্গে বসতে চায়নি। সবাইকে খাইয়ে, পরে খাবে বলে ভেবে রেখেছিল। কিন্তু সুজাতা রাজি হয়নি, একরকম জোরজার করে তাকেও সঙ্গে বসিয়ে দিয়েছে।
মণিকার ইঙ্গিতে এবং নির্দেশে সতীশ সবার প্লেটে খাবার দিয়ে যাচ্ছিল। একটা বড় মাছের মাথা সে যখন পরিমলের প্লেটে দিল তক্ষুনি পরিমল সেটা সুজাতার পাতে তুলে দিল। লজ্জায় এবং সুখে মুখটা আরক্ত দেখাচ্ছে সুজাতার।
ওদিকে সতীশ আর একটা মাছের মুড়ো সুশোভনের পাতে দিয়েছে। দ্রুত সুশোভন এবং মণিকা পরস্পরের দিকে একবার তাকায়। আগে হলে মুড়োটা কিছুতেই নিত না সুশোভন। মাছের মুড়ো মণিকার খুব পছন্দ। কিন্তু এখন তাদের যা সম্পর্ক তাতে হুট করে মুড়োটা তুলে দেওয়া যায় না। ভেতরে ভেতরে ভয়ানক
অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে লাগল সুশোভন।
এদিকে আচমকা চেঁচিয়ে উঠল পরিমল, ‘কি রে শালা, তুই তো টেরিফিক সেলফিশ দেখছি।‘
সুশোভন চমকে ওঠে, ‘কেন, কী করলাম?’
‘নিজে এত বড় মাছের মুড়োটা সাবড়ে দেবার তাল করছিস। আর তোর বউ মুখ চুন করে বসে আছে। বৌকে কী করে ভালোবাসতে হয় আমার একজাম্পল দেখেও শিখলি না। মুড়োটা মণিকার পাতে তুলে দে এক্ষুণি।‘
সুশোভন অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল, বোঝা গেল না। মণিকাই তাড়াতাড়ি বলে উঠল, মাছের মুড়ো-টুড়ো আমার ভাল লাগে না। ভীষণ কাটা।
এরপর যান্ত্রিক নিয়মে খেতে লাগল মণিকা আর সুশোভন। পরিমল অবশ্য প্রচুর কথা বলছিল। আর করছিল বিদেশবাসের সময়কার মজার মজার সব গল্প। একটু আধটু হাসছিল সুশোভন। মাঝে-মধ্যে হুঁ হাঁ করে যাচ্ছিল।
.
খাওয়া-দাওয়ার পর সুশোভন বলল, সতীশকে বিছানা করে দিতে বলি। তোরা একটু রেস্ট নে।
পরিমল জোরে জোরে মাথা ঝাঁকায়, দিবানিদ্রা দেবার জন্যে কুয়েত থেকে তোর এখানে এসেছি নাকি? কদিন এখন শুধু আড্ডা, বাংলা সিনেমা, তাস, বাংলা থিয়েটার, এটসেট্রা, এটসেট্রা।
দু’মিনিটের ভেতর কদিনের একটা প্রোগ্রামও ছকে ফেলে পরিমল। আজ এই দুপুরবেলায় তাসের আসর বসবে। বিকেলে চা-টা খেয়ে একটা বাংলা নাটক কি সিনেমা। রাত্রে ফিরে এসে আবার আচ্ছা, তারপর ডিনার, অবশেষে ঘুম। কাল সকাল থেকে আড্ডা-নাটক ইত্যাদি ব্যাপারগুলোর সঙ্গে ছেলেবেলার বন্ধুদের বাড়িতেও হানা দেবে। ক’টা দিন কলকাতাকে জমিয়ে মাতিয়ে পরিমলরা আবার কুয়েতে ফিরে যাবে। ঠিক হয়, কাল থেকে দিন চারেক সুশোভন ছুটি নেবে।