সুশোভন চমকে উঠল। পরিমল তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু। সেই স্কুল কলেজে পড়ার সময় থেকে যতদিন পরিমল কলকাতায় ছিল, রোজ দু’জনের একবার করে
দেখা না হতে চলত না। কতদিন পরিমল তাদের বাড়ি এসে থেকে গেছে, সে-ও গিয়ে থাকত পরিমলদের বাড়ি। কোনওদিন যে তাদের ছাড়াছাড়ি হবে, এ যেন ভাবাই যেত না।
পরিমল তার কাছে ক’দিন থাকবে। সোনার সুতো দিয়ে বোনা যৌবনের সেই দিনগুলো নতুন করে ফিরে আসবে, এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আর কী হতে পারে। কিন্তু কয়েক দিন না, কয়েকটা মিনিট থাকলেই তার আর মণিকার এখনকার সম্পর্কটা ওদের চোখে ধরা পড়ে যাবে। ভেতরে ভেতরে দারুণ গুটিয়ে গেল সুশোভন। ফ্যাকাসে একটু হেসে কোনওরকমের বলল, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।
সুজাতা ওধারের একটা সোফায় এর মধ্যে বসে পড়েছিল। সে এবার বলে উঠল, ‘আপনার মিসেস কোথায়? তার তো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বাড়িতে নেই?’
সুজাতার দিকে তাকাল সুশোভন। গোলগাল আদুরে চেহারা। চোখে মুখে হাসির আভা মাখানো। সে যে সুখী, তৃপ্ত সেটা যেন তার সর্বাঙ্গে হালকা লাবণ্যের মতো মাখানো রয়েছে।
সুজাতাকে আগে খুব বেশি দেখেনি সুশোভন। পরিমলের বিয়েটা প্রেম-ফ্রেম করে বিয়ে নয়। পুরনো স্টাইলে বাড়ি থেকে মেয়ে দেখে বিয়ের ব্যবস্থা করা। হয়েছিল। মেয়ে দেখার সময় একবার সুজাতাকে দেখেছে সুশোভন। তারপর বিয়ে এবং বৌভাতের দিন। পরে খুব সম্ভব বারদুয়েক। সুজাতার সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ বেশি পাওয়া যায়নি। যাই হোক, হৃৎপিণ্ড পলকের জন্য থমকে যায় সুশোভনের। কাঁপা দুর্বল গলায় সে বলে, বাড়িতেই আছে।
ওধারের সোফা থেকে প্রায় চেঁচিয়েই ওঠে পরিমল, তুই আশ্চর্য ছেলে তো বৌকে কোথায় গায়েব করে রেখেছিস? ডাক, এক্ষুনি ডেকে আন।
অগত্যা প্রায় মাসখানেক-মাসদেড়েক বাদে মণিকার বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল সুশোভন। দূরমনস্কের মতো এখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে মণিকা। পরিমলরা যে এসেছে, সে কি টের পায়নি?
কয়েক মুহূর্ত দ্বিধান্বিতের মতো তাকিয়ে থাকে সুশোভন। তারপর আস্তে করে ডাকল, মণিকা–
চমকে মুখ ফেরায় মণিকা। রীতিমত অবাকই হয়ে যায়। কতদিন পর সুশোভন তাকে ডাকল, মনে করতে পারল না। জিজ্ঞাসু চোখে সে তাকিয়ে থাকে।
সুশোভন এবার বলল, ‘পরিমলকে তো তুমি চেন।‘
মণিকা মাথা নাড়ল—চেনে। যদিও তার বিয়ের পর দু-একবার মাত্র পরিমলকে দেখেছে। অবশ্য সে যে সুশোভনের প্রাণের বন্ধু, এ খবর তার অজানা নয়।
সুশোভন বলল, ‘পরিমল ওর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে। ড্রইং রুমে বসে আছ। ওরা ক’দিন আমাদের এখানে থাকবে।‘
মণিকার চোখে মুখে চাঞ্চল্য ফুটে উঠল কিন্তু এবারও কিছু বলল না সে।
সুশোভন গলার ভেতর একটু শব্দ করল। তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘আমার একটা অনুরোধ রাখবে?’
মণিকা আবছা গলায় বলল, ‘কী?
‘আমাদের মধ্যে যা-ই হয়ে থাক না, পরিমলরা যেন বুঝতে না পারে। ওরা যে কদিন থাকে একটু অ্যাডজাস্ট করে নিও। আই মীন–’ বলতে বলতে থেমে যায় সুশোভন। তার দু’চোখে অনুনয়ের ভঙ্গি ফুটে ওঠে। অর্থাৎ বাইরের লোকজনের সামনে পরস্পরের তিক্ত সম্পর্কটা যাতে বিস্ফোরণের মতো ফেটে না পড়ে সেই জন্যই সুশোভনের এই কাকুতি-মিনতি।
মণিকা এক পলক ভেবে নিল। আর কদিন বাদেই দাদা এলে সে তো এলাহাবাদ চলে যাচ্ছেই। তার আগে দু-চারটে দিন সুখী দম্পতির রোলে অভিনয় করলই না হয়। যে সম্পর্ক চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাচ্ছে, যার আর জোড়া লাগার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, খুশি মুখে পরিতৃপ্ত ভঙ্গিতে কয়েকটা দিনের জন্য তার জের টেনে চলতে হবে। এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ডিভোর্স হয়নি, আইনের চোখে এখনও তারা স্বামী-স্ত্রী। এ সবই ঠিক, তবু মনে মনে তারা বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য প্রস্তুত হয়েই আছে। এই সময় আদর্শ স্বামী-স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করাটা একটা নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা বৈকি।
মণিকা বলল, ‘ঠিক আছে। তোমার সম্মান যাতে নষ্ট না হয়, যাতে কোনও রকম অস্বস্তিতে না পড় সেটা আমি দেখব।‘
মারাত্মক একটা টেনশান কেটে যায় সুশোভনের। দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে একটু হাসে সে। বলে, পরিমলরা ড্রইং রুমে বসে আছ। তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। বলে গভীর আগ্রহে মণিকার দিকে তাকাল।
সুশোভনের ইচ্ছেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না মণিকার। খাট থেকে নামতে নামতে সে বলে, চল, আমি যাচ্ছি। একটু পরে সুশোভনের সঙ্গে ড্রইং রুমে এসে স্নিগ্ধ হেসে মণিকা পরিমলকে বলে, কতদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা। কী ভাল যে লাগছে। আমাদের এখানে কিন্তু কদিন থেকে যেতে হবে। পরিমলরা যে এখানে থাকতেই এসেছে সে খবর সুশোভনের কাছে কিছুক্ষণ আগেই পেয়েছে মণিকা। তবু কথাটা যে বলল, সেটা নিতান্তই আন্তরিকতা বোঝাবার জন্য।
পরিমল বলল, ‘থ্যাংক ইউ। আমরা তো সেইরকম প্ল্যান করেই এসেছি। ক’টা দিন হই-হই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।‘
মণিকা হেসে হেসে বলল, আপনারা দুই বন্ধু গল্প করুন। আমি এঁর সঙ্গে একটু কথাটথা বলি। আপনাদের বিয়ের সময় সেই একবার মোটে দেখেছিলাম। তারপর যে দু’বার কলকাতায় এসেছিলেন তখন আমি এলাহাবাদে, বাপের বাড়িতে। বলতে বলতে সুজাতার পাশে গিয়ে বসল মণিকা। বলল, ‘প্রথমেই বলে রাখছি, আমি কিন্তু আপনি-টাপনি করে বলতে পারব না।