সামনের দিকে অনেকখানি ঝুঁকে, জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে গলার স্বরটা ঝপ করে নামিয়ে দিয়ে বলল, তারা হলেন, অনির্বাণ, দীপিকা আর প্রতাপ।
শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ খেলে গেল অনির্বাণের। তার গলা চিরে দুটি শব্দ বেরিয়ে এল–তুমি কে?
আমার মায়ের নাম দীপিকা, আপনার অতল জল-এ যিনি সুদীপ্তা আর বাবা হলেন প্রতাপ উপন্যাসে যিনি বিক্রম।
এতদিনে সেই ধন্দটা কেটে গেল অনির্বাণের। সর্বাণীর মুখে কার আদলটি আবছাভাবে বসানো, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল।
সারা শরীর উথাল পাথাল হয়ে যাচ্ছে। বিহুলের মতো তাকিয়ে রইলেন অনির্বাণ। মাথার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে।
সর্বাণী উঠে পড়েছিল। বলল, স্যার, আজ আমার একটু তাড়া আছে। যাচ্ছি। সে চলে গেল।
অনেকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে থাকার পর অনির্বাণের অস্থির অস্থির ভাবটা কমে এল।
সর্বাণী কেন তাঁর কাছে প্রায় প্রতিটি ছুটির দিনে এসেছে? সে যে তার ভক্ত পাঠিকা সেটা বোঝাতে; নাকি অন্য কোনও উদ্দেশ্য ছিল? সে যে আসে দীপিকা কি তা জানে? জেনে শুনেও কি যে পুরুষটির সঙ্গে সম্পর্কের গিট ছিঁড়ে একদিন প্রতাপের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল, তার কাছে নিজের মেয়েকে বারবার পাঠিয়েছে? সর্বাণী তার মা-বাবার সঙ্গে তার সম্পর্কটা জানল কী করে? নানা প্রশ্ন চারদিক থেকে ধেয়ে আসতে লাগল।
না না, এসব ভেবে নিজেকে ভারাক্রান্ত করার মানে হয় না। অনির্বাণ একটা সিদ্ধান্ত নিলেন।
পরদিন কলেজে গিয়ে লম্বা ছুটি পেয়ে প্রিন্সিপালকে দরখাস্ত দিয়ে সোজা একটা এজেন্সির অফিসে চলে এলেন। এরা নানা লটবহর এক শহর থেকে আরেক শহরে নিয়ে যায়। দুদিন বাদে একটা ট্রাক এসে বইপত্র, ব্যাগ স্যুটকেস-টুটকেস গুছিয়ে নিয়ে কলকাতায় চলে গেল। সেখানে অনির্বাণদের বাড়িতে সেসব পৌঁছে দেবে।
ফার্নিচারগুলো ভাড়া করা। আরও তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া, আসবাবের ভাড়া, শিবু এবং নিতাইয়ের মায়ের মাইনে চুকিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠলেন অনির্বাণ। জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলেন, কলকাতায় গিয়ে কটা দিন নিজেদের বাড়িতে চুপচাপ শুয়ে থাকবেন। তারপর সটান চলে যাবেন হায়ার এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের অফিসে। এই অফিসের অনেক সিনিয়র আধিকারিক তাকে পছন্দ করেন। তাদের অনুরোধ করলে অন্য কোনও শহরে ট্রান্সফার হয়ে যাবেন। বেগমপুরে ফিরে গেলে রবিবার রবিবার সর্বাণী যেমন আসে হয়তো তেমনই আসবে। তার সঙ্গে কোনও একদিন দীপিকাও চলে আসতে পারে। না এলেও রাস্তায় কখনও দেখা হয়ে যেতে পারে। বহু বছর আগে দীপিকা প্রতাপের সঙ্গে পালিয়ে যাবার পর ভেঙে-চুরে খান খান হয়ে গিয়েছিলেন অনির্বাণ। সময়ের হাতে বোধ হয় আশ্চর্য কোনও ম্যাজিক থাকে। ধীরে ধীরে সব ক্ষত শুকিয়ে গেছে, নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। লেখালেখি, কলেজের পড়ানো ছাড়া অন্য কোনও দিকে আর তাকাবেন না। বাকি দিনগুলো এভাবেই কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু দীপিকা? না। জীবনটাকে নতুন করে জটিল করে তোলার লেশমাত্র ইচ্ছা নেই অনির্বাণের।
ইলেকট্রিক ট্রেন দুরন্ত গতিতে বেগমপুরের সীমানা ছাড়িয়ে কলকাতার দিকে দৌড় শুরু করল।