দেখবার মতো কিছু নেই। অনির্বাণ হাসলেন–তবু যখন তোমার ইচ্ছে, এসো।
দোতলায় তিনটে বড় বড় ঘর একটা হল অনির্বাণের স্টাডি। এখানে মস্ত একটা টেবিলের ওপর কম্পিউটার, পাঁচ-ছটা ডিকশনারি, টেলিফোন, আট-দশটা পেন, আঠার টিউব ইত্যাদি। দুধারের দেওয়াল জোড়া র্যাকে গাদাগাদি করে রাখা অজস্র ইংরেজি এবং বাংলা বই। একপাশে ডিভান এবং দুটো সোফাতেও ভঁই করা বই এবং ম্যাগাজিন। সব ছত্রখান হয়ে রয়েছে।
অনির্বাণ বললেন, এটাই আমার লেখা আর পড়ার ঘর। বুঝতেই পারছ আমি কেমন মানুষ। অগোছালো, ছন্নছাড়া। বেডরুমটা দেখলে বোধ হয় ভিরমি খাবে। চলো, সেটাও দেখাই।
লেখার ঘরের চাইতেও বেডরুমের হাল অনেক বেশি করুণ। ময়লা জামা প্যান্ট, বিছানার চাদর, যেদিকে তাকানো যায়, সব লন্ডভন্ড। যেন সারা ঘর জুড়ে ঝড় বয়ে গেছে। সর্বাণী বলল, লেখকরা সব ব্যাপারেই খুব উদাসীন হয় দেখছি। আমি ঘর দুটো গুছিয়ে-টুছিয়ে দেব?
না না, সে কী কথা ভীষণ বিব্রত হয়ে পড়েন অনির্বাণ। এসব তোমাকে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে না।
কিন্তু সর্বাণী শুনল না। রবিবার এসে গল্প-টল্প তো করেই, ফাঁকে ফাঁকে ঘর দুটো গোছগাছও করে দেয়। পড়ার ঘর আর বেডরুমের চেহারাই পালটে গেল। এক রবিবার সর্বাণী এসে দেখল, সেদিনই সকালে বাথরুমে পড়ে গিয়ে হাতে চোট পেয়েছেন অনির্বাণ। শিবু ছুটি নিয়ে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। নীচের ভাড়াটেদের যে ডেকে আনা হবে তারও উপায় নেই। তারা ভোরবেলা বন্ধুদের সঙ্গে দল বেঁধে কোথায় যেন পিকনিকে গেছে।
সারা বাড়িতে নিতাইয়ের মা ছাড়া আর কেউ নেই। সে কাপড় গরম করে সেঁক-টেক দিয়েছে ঠিকই কিন্তু তাতে যন্ত্রণা খুব একটা কমেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনির্বাণ উঃ আঃ করছেন। এই সময় সর্বাণী এল। সব শুনে তক্ষুনি বেরিয়ে গিয়ে ডাক্তার ডেকে এনে প্লাস্টারের ব্যবস্থা করল। এই রকম নানা ব্যাপারে ক্রমশ সর্বাণীর ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছেন অনির্বাণ, হয়তো নিজের অজান্তেই। কোনও কারণে সে আসতে পারলে মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু কার সঙ্গে সর্বাণীর চেহারার মিল সেই ধন্দটা এখনও কাটেনি।
এক ছুটির দিনে চা খেতে খেতে অনির্বাণ বললেন, আমার কথা তো সবই শুনেছ। তোমার সম্বন্ধে আমি কিন্তু বিশেষ কিছুই জানি না।
সর্বাণী হাসল–আমাদের কথা বলার মতো নয়। বাড়িতে শুধু আমি আর আমার মা।
বাবা?
নেই।
মানে?
তিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। সাত-আট বছর আগে এখানকার নদীর ওপর বাঁধ তৈরি হচ্ছিল। বাবা ইন্সপেকশনে গিয়েছিলেন। আচমকা ওপর থেকে লোহার একটা বিম এসে পড়ে তার ওপর। স্পষ্ট ডেড। আমাদের বাড়ি কলকাতায়। বাবার মৃত্যুর পরে আমরা সেখানে যাইনি। তার কোম্পানিই আমাদের জন্যে এই শহরে একটা বাড়ি করে দিয়েছে। প্রত্যেক মাসে পঁচিশ হাজার টাকা করে দেয়। একটা প্রাণের বদলে আমরা কমপেনসেশন পাচ্ছি।
ভেরি স্যাড- অনির্বাণের সারা মুখ বিষাদে ভরে গেল।
অনেকক্ষণ নীরবতা।
তারপর একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল সর্বাণী।–স্যার, এক-দেড় মাস আগে বলেছিলাম আপনার অতল জল উপন্যাসটা সম্পর্কে আমার কিছু প্রশ্ন আছে। আরও বলেছিলাম, বইটা আরেকবার পড়ে নেব। তারপর আপনার সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলব। এর মধ্যে পড়া হয়েও গেছে।
ভুলেই গিয়েছিলেন অনির্বাণ। মনে পড়ে গেল। বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছিলে। তা হঠাৎ অতল জলকে টেনে নিয়ে এলে!
তিনি বেশ অবাকই হয়েছেন।
বাড়ির সমস্ত কিছুই তো জানিয়ে দিয়েছি। এবার অতল জল নিয়ে আমার কৌতূহলটা মিটিয়ে নিই। না বলবেন না স্যার।
ঠিক আছে।
উপন্যাসের তিনটে প্রধান ক্যারেক্টার। শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম। শান্তনু শান্ত, ভদ্র, নিস্পৃহ ধরনের মানুষ। উচ্চ শিক্ষিত। পড়াশোনা নিয়ে থাকতে পছন্দ করে। ভালো চাকরি করে, তবে তা বদলির চাকরি। তিন-চার বছর পর পর তাকে নানা জায়গায় পাঠানো হয়। শান্তনুর স্ত্রী সুদীপ্তা সুন্দরী। এমন রূপ যে তার দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যায়। ঘরের কোণে ভ্যাদভেদে গৃহলক্ষ্মী হয়ে পড়ে থাকতে তার দমবন্ধ হয়ে আসে। সে চায় ঘরের দেওয়াল ভেঙে উড়ে বেড়াতে। তার এটা চাই, সেটা চাই, চাহিদার শেষ নেই। তা ছাড়া এখানে নিয়ে যাও, সেখানে নিয়ে যাও। উপন্যাসের তিন নম্বর লিডিং ক্যারেক্টার হল বিক্রম। সে শান্তনুর বন্ধু; একটা মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির টপ একজিকিউটিভ। আজ ইউরোপে যাচ্ছে, কাল আমেরিকায়। বিক্রম প্রবল শক্তিমান পুরুষ। যা সে চায় তা ছিনিয়ে নেয়। ক্লাব, পার্টি, মদ এবং বান্ধবীদের তো তার কাম্য ছিল। একদিন বিক্রমের সঙ্গে সে স্বামী সংসার ফেলে চলে গেল। বলে সোজাসুজি অনির্বাণের দিকে তাকাল–আপনার উপন্যাসে এরকমই রয়েছে। আপনি বলেছিলেন, চারপাশের চেনা জানা মানুষ এবং ঘটনা নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখেন। শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম নিশ্চয়ই বাস্তব চরিত্র।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন অনির্বাণ তারপর চাপা গলায় বললেন, হ্যাঁ, মানে
অনির্বাণের কথা যেন শুনতেই পেল না সর্বাণী। বলতে লাগল, আপনার কাছে আগেই শুনেছি বাস্তব চরিত্রের নামটাম বদলে তার সঙ্গে কল্পনা মিশিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখেন। অন্য গল্প-টল্প কাদের নিয়ে লিখেছেন বলতে পারব না। তবে অতল জল-এর তিনটে ক্যারেক্টারের আসল নাম-টাম আমি জানি। তারা শান্তনু, সুদীপ্তা আর বিক্রম নন।