ক্রমশ যত দিন গেছে, দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছিল। পারস্পরিক শ্রদ্ধা বিশ্বাস বা মমতা বলতে কিছুই প্রায় আর অবশিষ্ট ছিল না। রাত্তিরে এক ঘরে তারা থাকে না। তাদের বিছানা আলাদা হয়ে গেছে। কথাবার্তাও একরকম বন্ধ। সুশোভন ফ্ল্যাটে থাকলে পাশাপাশি দুই ঘরে তারা চুপচাপ বসে থাকে। ইদানীং বেশ কিছুদিন বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে ডাকে না সে। ওদের কারও কিছু দরকার হলে সতীশকে দিয়ে বলায়। সমস্ত ফ্ল্যাট জুড়ে এখন দম বন্ধ করা আবহাওয়া।
এভাবে মন এবং স্নায়ুর ওপর মারাত্মক চাপ নিয়ে জীবন কাটানো অসম্ভব। এর মধ্যে একদিন মণিকা সোজা তার ঘরে এসে বলেছে, ‘তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।’
প্রায় দেড়মাস পর সুশোভনের ঘরে এসেছিল মণিকা। রীতিমত অবাকই হয়ে গিয়েছিল সুশোভন। বলেছিল, কী কথা?
‘আমরা যেখানে এসে পৌঁছেছি তাতে নিশ্চয়ই তোমার খুব অসুবিধে হচ্ছে।‘
‘আমার কথা থাক। অসুবিধাটা বোধহয় তোমারই বেশি। তা কী করতে চাও তুমি?’
‘এলাহাবাদ যেতে যাই। দাদাকে চিঠি লিখেছি। কয়েকদিনের ভেতরেই আমাকে নিতে আসবে।‘
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল সুশোভন। তারপর বলেছিল, একেবারে নিয়ে যাবার জন্যে চিঠি লিখে ফেললে! একটু থেমে বলেছিল, ঠিক আছে।
তারপর থেকে শুধু অমলের জন্য অপেক্ষা করে থাকা। আজ কাল পরশু, যে কোনওদিন সে এসে পড়তে পারে। সুশোভনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি, অমলের সঙ্গে সেই যে মণিকা চলে যাবে, আর কোনওদিনই ফিরবে না।
কতক্ষণ আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে মণিকার দিকে তাকিয়েছিল, খেয়াল নেই। আচমকা কলিং বেল বেজে উঠল।
আজকাল তাদের ফ্ল্যাটে বিশেষ কেউ আসে না। বন্ধুবান্ধব, অফিসের কলিগ, অ্যাড-ফিল্মের মডেলরা—কেউ না। মণিকার সঙ্গে তার সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে। পৌঁছেছে, মোটামুটি সবাই তারা জেনে গেছে। তাই পারতপক্ষে এধার মাড়ায় না। একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার ভেতরে গিয়ে কী লাভ?
সুশোভন প্রথমটা ভেবেছিল, জমাদার বাথরুম সাফ করতে এসেছে। কিংবা যে ছেলেটা মিল্ক বুথ থেকে দুধ এনে দেয় সে-ও হতে পারে। যে-ই আসুক বিশেষ, কৌতূহল নেই সুশোভনের। ওরা এলে সতীশ দুধ নিয়ে ফ্রিজে রেখে দেবে বা বাথরুম পরিষ্কার করাবে। কাজকর্মে লোকটা দারুণ চৌখস।
একটু পরেই দরজা খোলার আওয়াজ কানে এল। পরক্ষণেই ফ্ল্যাট কাঁপানো চিৎকার, সুশোভন কোথায় রে?
গলার আওয়াজেই টের পাওয়া গেল পরিমল। আস্তে, গলার স্বর নিচু পর্দায় নামিয়ে কথা বলতে পারে না সে। কলেজে সুশোভনের সঙ্গে পড়ত। পরে এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিগ্রি নিয়ে চাকরি যোগাড় করে ক’বছর আগে মিডল ইস্টে চলে গিয়েছিল। ওখানে তাদের কোম্পানি কী একটা প্ল্যান্ট বসাচ্ছে। সেখানে পরিমল টপ একজিকিউটিভ এঞ্জিনিয়ার।
ব্যস্তভাবে খাট থেকে নেমে বাইরে আসতেই সুশোভনের চোখে পড়ে, লিভিং কাম-ড্রইং রুমে পরিমল আর তার স্ত্রী সুজাতা দাঁড়িয়ে আছে। পরিমলের হাতে একটা মাঝারি সাইজের দামি সুটকেস। তাকে দেখেই সুটকেসটা নামিয়ে রেখে প্রায় দৌড়ে এসে দু’হাত জড়িয়ে ধরল, ‘কেমন আছিস রে শালা?’
সেই কলেজ লাইফ থেকেই পরিমলটা দারুণ হুল্লোড়বাজ আর আমুদে। তার মধ্যে কোনওরকম প্যাঁচ বা নোংরামি নেই। ওর স্বভাব অনেকটা দমকা বাতাসের মতো-ও এলেই মনে হয় ঘরের সব বন্ধ দরজা-জানলা খুলে গেল।
পরিমলকে দেখে মনটা খুশি হয়ে গেল সুশোভনের। বলল, এই চলে যাচ্ছে। তোরা কেমন আছিস বল।
‘আমরা কখনও খারাপ থাকি না। অলওয়েজ ইন আ জলি গুড মুড। আমাদের মতো স্বামী-স্ত্রী হোল ওয়ার্ল্ডে খুব বেশি খুঁজে পাবি না।‘ বলে ঘাড় ফিরিয়ে চোখের কোণ দিয়ে স্ত্রীকে দেখতে দেখতে পরিমল বলল, ‘না কি বল?’
সুজাতা হাসল, অর্থাৎ পরিমল এবং সুজাতা দাম্পত্য জীবনে খুবই সুখী। পারফেক্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং বলতে যা বোঝায় তা তাদের রয়েছে। হঠাৎ নিজের আর মণিকার কথা মনে পড়তে অদ্ভুত বিষাদে বুকের ভেতরটা ভরে যেতে লাগল সুশোভনের।
বন্ধুকে ছেড়ে দিয়ে একটা সোফায় বসতে বসতে পরিমল বলল, অনেকদিন পর তোর সঙ্গে দেখা হল। কী ভাল যে লাগছে!
সুশোভন দাঁড়িয়েই ছিল। একটু ভেবে বলল, ‘হ্যাঁ, প্রায় বছর পাঁচেক পর তোকে দেখলাম। এখন যেন তুই মিডল-ইস্টে কোথায় পোস্টেড?’
‘কুয়েতে। আমাদের কোম্পানি ওখানে একটা বিরাট এয়ারপোর্ট তৈরি করছে।‘
সুশোভন জানত, যাদবপুর থেকে ডিগ্রি নিয়ে বেরুবার পর পরিমল বছর দুই তিন কলকাতার একটা ফার্মে কাজ করেছে। তারপর চলে যায় বম্বে অন্য একটা কোম্পানিতে। সেই কোম্পানি মিডল-ইস্ট আর আফ্রিকার নানা দেশে বিরাট বিরাট প্রোজেক্ট করেছে। ক’বছর ধরে পরিমল এই সব প্রোজেক্টের কাজে কখনও আবুধাবি, কখনও বাগদাদ, কখনও ত্রিপোলিতে রকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে দিনরাত তার এত ব্যস্ততা যে দেশে ফেরার সময়ই পায় না। আগে তবু দেড় দু’বছর পর পর। আসতে পারত। ক’বছর আগে একবার সুজাতাকে বিয়ে করতে এসেছিল। এবার তো এল পাঁচ বছর বাদে।
পরিমল বলল, এবার একমাসের ছুটি নিয়ে এসেছি। লাস্ট উইকে বম্বে পৌঁছেছি। হেড অফিসে দুটো জরুরি কনফারেন্স ছিল। সেসব সেরে পরশু মর্নিং ফ্লাইটে এসেছি কলকাতায়। তোকে সারপ্রাইজ দেব বলে ফোন-টোন না করেই চলে এলাম। কতকাল একসঙ্গে থাকি না। এবার তোর এখানে তিন-চার দিন থেকে যাব। সুটকেসটা দেখিয়ে বলল, এই দ্যাখ, একেবারে জামাকাপড় নিয়ে রেডি হয়ে এসেছি।