অনির্বাণ বললেন, প্রথম দিন এলে। একটু কিছু না খেলে আমার খারাপ লাগবে।
চা মিষ্টি-টিষ্টি এসে গেল। খাওয়া শেষ হলে সর্বাণী বলল, এবার যাই স্যার। আবার কিন্তু আসব।
এসো।
মেয়ে দুটি চলে যাবার পরও ইজিচেয়ারে বসেই রইলেন অনির্বাণ। এবেলা আর লেখা-টেখা হবে না, আগেই বোঝা গেছে। সেই চিন্তাটা মাথায় ফিরে এল। বেগমপুর শহরে এই তার প্রথম আসা। সর্বাণীকেও প্রথম দেখলেন। তার মুখের সঙ্গে কার মুখের আবছা মিল?
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে একরকম চেহারার দুজন মানুষ দেখা যে যায়নি, তা তো নয়। তাদের রক্তের সম্পর্ক নেই। একজন হয়তো জন্মেছে বিহারে, অন্যজন রাজস্থানে। সর্বাণীর চিন্তাটা খারিজ করে দিতে চাইলেন অনির্বাণ কিন্তু মেয়েটা যেন তাঁর মাথায় চেপে বসে আছে।
চুয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরের জীবনে কম মানুষ তো দেখেননি অনির্বাণ। তাদের অনেককেই ভুলে গেছেন। কেউ কেউ একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। স্মৃতি খুঁড়ে খুড়ে যাদের তুলে আনা গেল তাদের কারও সঙ্গেই সর্বাণীর মিল নেই। কী যে অস্বস্তি! মনটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে রইল।
.
সেই যে সর্বাণী আর মল্লিকা এসেছিল তারপর বেশ কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। এর মধ্যে অনির্বাণ সামান্য লেখালেখি করেছেন, কলেজে গিয়ে ক্লাস নিয়েছেন। মনের অশান্ত ভাবটা অনেকখানি কেটে গেলেও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। নীচের তলায় ভাড়াটেরা ফিরে এসেছে। তাদের সঙ্গে দেখা হলে কেমন আছেন স্যার, আপনারা ভালো তো সম্পর্কটা এর বেশি এগোয়নি। অনির্বাণ যতদিন বেগমপুরে আছেন, এমনটি চলছে।
তিন সপ্তাহ পর এক রবিবার আবার এল সর্বাণী! সে একাই এসেছে। সঙ্গে তার বন্ধুটি নেই। হাসি মুখে বলল, আগেই আসতাম। মাঝখানে কটা দিন জ্বরে ভুগলাম। তাই।
বুকের ভেতর যে অস্বস্তিটা কমে এসেছিল সেটা ফের বেড়ে গেল। অনির্বাণ চাপা স্বভাবের মানুষ। ভেতরে যা চলে তা বাইরে বেরিয়ে আসতে দেন না। সর্বাণীকে বসতে বলে জিগ্যেস করলেন, এখন কেমন আছ?
ভালো স্যার। কদিন বাড়িতে আটকে ছিলাম। জ্বরটা ছাড়ছিল না। এক উইক হল রেগুলার ক্লাস করছি। আপনি ভালো আছেন তো?
ওই চলে যাচ্ছে।
এলোমেলো কিছু কথা হল। তারপর সর্বাণী বলল, আপনার অসমাপ্ত উপন্যাসের শেষটা ট্র্যাজিক হল কেন? বিকাশ আর শিপ্রাকে মিলিয়ে দিলে কিন্তু অনেক ভালো লাগত।
তাই বুঝি? অনির্বাণ একটু হাসলেন। কোনও উত্তর দিলেন না।
আপনার সমান্তরাল, পটভূমি, ধূসর পৃথিবী উপন্যাসগুলোতেও নায়ক নায়িকার মিলন ঘটাননি। আপনার লেখায় দুঃখ, কষ্ট-টষ্ট বড্ড বেশি।
অনির্বাণ বললেন, মানুষের জীবনে দুঃখ কষ্ট নেই?
তা আছে তাই বলে এত? একটু কম কম করে এসব দিয়ে পাঠক যাতে আনন্দ পায় এবার থেকে সেই রকম লিখুন না।
অস্বস্তি থাকলেও মজা লাগছিল অনির্বাণের। লঘু সুরে বললেন, তোমার কথাগুলো ভেবে দেখতে হবে।
আরও কিছুক্ষণ কাটিয়ে সর্বাণী চলে গেল।
আবার এল পরের রবিবার। এবারও একা। স্যার কেমন আছেন, তুমি ভালো আছ তো-ইত্যাদির পর সর্বাণী বলল, একটা কথা ভাবলে আমার খুব অবাক লাগে।
উৎসুক দৃষ্টিতে সর্বাণীর দিকে তাকালেন অনির্বাণ। কোনও প্রশ্ন করলেন না।
সর্বাণী বলতে লাগল, আপনি কতগুলো গল্প উপন্যাস লিখেছেন?
তুমি তো আমার একজন দুর্দান্ত পাঠিকা। তুমিই বলো না
চোখ কুঁচকে একটু ভাবল সর্বাণী। তারপর বলল, একত্রিশটা উপন্যাস। গল্প অনেক; কতগুলো বলতে পারব না।
উপন্যাসের নাম্বারটা ঠিক বলেছ। গল্প কত লিখেছি, আমারই মনে নেই। দেড়শো তো হবেই।
আচ্ছা
আবার কী?
এত সব যে লিখেছেন, আরও লিখছেন; আইডিয়া, গল্পের প্লট পান কীভাবে?
মেয়েটির অনন্ত কৌতূহল। অনির্বাণ বললেন, চারপাশের মানুষজনকে দেখে।
যেমনটা দেখেন অবিকল তাই লেখেন?
শুধু অভিজ্ঞতার ওপর লেখা হয় না। তার সঙ্গে কল্পনা মেশাতে হয়। তবেই কিছু সৃষ্টি হয়।
খুব ডিফিকাল্ট ব্যাপার।
সর্বাণীর মুখচোখের ভাবভঙ্গি দেখে হাসিই পাচ্ছিল অনির্বাণের। তিনি অবশ্য কিছু বললেন না।
সর্বাণী বলল, আপনার অতল জল উপন্যাসটা নিয়ে আমার কিছু জানার আছে।
কী জানতে চাও, বলে ফেলো।
আজ নয়, বইটা আরেকবার পড়ে নিই। তারপর বলল।
ঠিক আছে।
ফি রবিবার সর্বাণীর আসাটা নিয়মে দাঁড়িয়ে গেল। যে অনির্বাণ নির্বিকার, সমস্ত ব্যাপারেই যাঁর চরম উদাসীনতা সেই তিনিই রবিবার সকাল থেকেই আশ্চর্য এই মেয়েটির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন।
একদিন এসে সর্বাণী বলল, স্যার, রাগ না করলে একটা কথা জিগ্যেস করতাম।
কেন রাগ করব? বলো না
আমি তো দু-আড়াই মাস ধরে আসছি। দুজন কাজের লোক বাদ দিলে আপনাকে ছাড়া অন্য কারওকে তো দেখি না।
আমি এখানে একাই থাকি।
অন্য সবাই?
অন্য সবাই বলতে আমার মা, ছোট এক ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রী। তারা সব শ্যামবাজারে আমাদের পৈতৃক বাড়িতে থাকে।
কিন্তু ম্যাডাম?
পলকহীন কয়েক সেকেন্ড সর্বাণীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অনির্বাণ। তারপর নীরস গলায় বললেন, তুমি কার সম্বন্ধে জানতে চাইছ, বুঝেছি। কিন্তু তেমন কেউ আমার লাইফে নেই।
সর্বাণী চুপ করে রইল।
আরও মাস দেড়-দুই এভাবেই কেটে গেল। দু-একটা রবিবার বাদ দিলে বাকি সব ছুটির দিনই সে এসেছে। যখনই আসে, তাকে বাইরের বারান্দায় বসিয়ে গল্প করেন অনির্বাণ।
এক রবিবার এসে সর্বাণী নানা কথার ফাঁকে বলল, স্যার, আপনি কোথায় বসে লেখেন দেখতে ইচ্ছে করছে।