অনির্বাণ রীতিমতো অবাক। তিনি ইজিচেয়ার থেকে উঠে বারান্দার রেলিংয়ের কাছে এসে দাঁড়ালেন। নিতাইয়ের মা তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুরে আঙুল বাড়িয়ে তাকে দেখিয়ে দিল।
মেয়ে দুটি এবার অনির্বাণকে দেখতে পেয়েছে। তাদের একজন বলল, স্যার, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ভেতরে আসব?
একটু বিরক্ত হলেন অনির্বাণ। ভেবেছিলেন খবরের কাগজ দেখা হলে লেখার টেবিলে গিয়ে বসবেন। একটা নামকরা মাসিক পত্রিকার সম্পাদক অনবরত তাড়া দিচ্ছেন, দিন পনেরোর মধ্যে নভেলেট লিখে দিতে হবে।
নাঃ, এবেলাটা মাটিই হবে। একবার ভাবলেন এখন আমি ব্যস্ত আছি বলে ওদের চলে যেতে বলবেন। আবার একটু কৌতূহলও হচ্ছিল। দোনোমনো করে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন, আচ্ছা এসো।
মেয়ে দুটি উঠোন পেরিয়ে ওপরে উঠে এল। দোতলার বারান্দার দেওয়াল ঘেঁষে তিন চারটি বেতের মোড়া রয়েছে। ওখান থেকে দুটো নিয়ে এসে এখানে বোসো বলে ইজিচেয়ারটায় বসলেন অনির্বাণ। মেয়ে দুটি তাঁকে প্রণাম করে মোড়া টেনে এনে সামনা সামনি, তবে একটু দূরে ধীরে ধীরে বসে পড়ল।
অনির্বাণ লক্ষ করছিলেন। একটি মেয়ে খুবই সুশ্রী, টকটকে রং। অন্যটির গায়ের রং চাপা হলেও দেখতে ভালোই। বললেন, তোমরা কারা? চিনতে পারলাম না তো।
সুশ্রী মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ। বলল, আমার নাম সর্বাণী আর ও আমার বন্ধু, ওর নাম মল্লিকা। আমরা এই শহরেই থাকি।
অনির্বাণদের কলেজটা কো-এড। হাজারখানেকের মতো ছাত্ৰ-ছাত্ৰী। মাত্র তিন মাস তিনি এখানে এসেছেন। সব স্টুডেন্ট তো নয়ই, তার সাবজেক্টের ছেলেমেয়েদের মুখও তার স্পষ্ট মনে থাকে না। জিগ্যেস করলেন, তোমরা কি আমার কলেজে পড়ো?
সর্বাণী বলল, না স্যার। এখানে একটা গার্লস কলেজ আছে। আমরা সেই কলেজের স্টুডেন্ট। আমার পলিটিক্যাল সায়েন্সে অনার্স, মল্লিকার সোশিয়লজিতে। দুজনেই ফার্স্ট ইয়ার।
অনির্বাণের কোনও ব্যাপারেই তেমন আগ্রহ নেই। নির্বিকার ধরনের মানুষ। কম কথা বলেন। যেটুকু বা বলেন, অন্যমনস্কর মতো।
আচমকা দুই সদ্য তরুণী এসে পড়ায় তিনি খুশি হননি ঠিকই, তবে বিরক্তি প্রকাশ করাটা অশোভন। জিগ্যেস করলেন, তোমরা যে এলে, কোনও দরকার আছে কি?
সর্বাণী উজ্জ্বল চোখে তাকাল। আপনার লেখা গল্প-উপন্যাস আমাদের খুব ভালো লাগে। আপনি বেগমপুর গভর্নমেন্ট কলেজে আসার পর থেকে ভীষণ দেখা করতে ইচ্ছে করছিল। শুনেছি আপনি খুব গম্ভীর। তাই ভয় ভয় করছিল। শেষ পর্যন্ত সাহস করে চলে এলাম।
সুদূর এই মফস্সল শহরে তার লেখার দুজন অনুরাগিণী পাওয়া যাবে, ভাবা যায়নি। ছুটির দিনে হঠাৎ এসে লেখালেখি পণ্ড করায় মনে যে বিরক্তি জমা হয়েছিল, তার ঝঝ কমে এল। অনির্বাণ বললেন, শুনতে পাই, আজকালকার ছেলেমেয়েরা বাংলা-টাংলা পড়ে না। বেঙ্গলি লিটারেচারের নামে তাদের জ্বর আসে।
স্যার, কলকাতার ব্যাপারটা বলতে পারব না। আমাদের এই মফসসল শহরে কলেজ কি স্কুল লাইব্রেরিগুলো ছাড়াও তিনটে বিরাট বিরাট পাবলিক লাইব্রেরি আছে। তার প্রত্যেকটায় পনেরো-ষোলো হাজার করে বই। বয়স্ক মানুষেরা তো বটেই, আমাদের বয়সি কি আমাদের চেয়ে ছোট অনেকেই সেগুলোর মেম্বার। সুধাকর বাগচি, নীরেন্দ্র ঘোষ আর আপনার লেখার কত যে ভক্ত এখানে রয়েছে, ভাবতে পারবেন না স্যার।
কলকাতায় থাকলে নানা হতাশাজনক কথা কানে আসে। বাঙালি বাংলা বই পড়ছে না, বাংলা বই বিক্রি হচ্ছে না, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সর্বাণীর কথাগুলো শুনতে শুনতে বেশ ভালোই লাগল। অনির্বাণ একটু হাসলেন।
সর্বাণী থামেনি। সে বলতে লাগল, আমাদের এই বেগমপুরের চল্লিশ-পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে আরও তিন-চারটে ছোট শহর আছে। সেই শহরগুলোতেও বড় বড় অনেক লাইব্রেরি রয়েছে। প্রত্যেকটা টাউনের নাইনটি পারসেন্ট মানুষ বাংলা বই পড়ে।
কোনও ব্যাপারেই যিনি উৎসুক নন, এবার তার চোখেমুখে আগ্রহ ফুটে ওঠে, তাই?
হ্যাঁ স্যার।
তা হলে তো দেখা যাচ্ছে, কলকাতা নয়, মফসল শহর আর গ্রাম-ট্রামগুলো বাংলা সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রেখেছে। বলতে বলতে অনির্বাণ সর্বাণীর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। আগেই চোখে পড়েছিল মেয়ে দুটির মধ্যে সর্বাণী খুবই সুন্দরী, অন্য মেয়েটি অর্থাৎ মল্লিকা তেমনটা নয়। সে চুপচাপ, লাজুক ধরনের। এখন পর্যন্ত একটি কথাও বলেনি। আর সর্বাণী অবিরল কথা বলে চলেছে।
অনির্বাণের যা স্বভাব, কাছে বসে থাকলেও অন্যমনস্কর মতো তাকে দেখেন। কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম ঘটল। সর্বাণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল। কার একটা হালকা আদল যেন তার চেহারায় বসানো? কার? ঠিক মনে পড়ছে না। হুবহু না হলেও এই ধরনের মুখ আগে কোথাও দেখেছেন।
যেভাবে তিনি তাকিয়ে আছেন সেটা অশোভন। ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিলেন অনির্বাণ।
কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে সর্বাণী বলল, স্যার, আপনার অনেকটা সময় নষ্ট করলাম। এবার আমরা যাই।
ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অনির্বাণ, না না, আরেকটু বোসো গলার স্বর উঁচুতে তুলে ডাকলেন, নিতাইয়ের মা, দেখ তো মিষ্টি-টিষ্টি আছে কিনা, থাকলে দুজনের মতো নিয়ে এসো, তারপর চা করে দিয়ো। আমিও খাব।
সর্বাণী হাত নেড়ে অস্বস্তির সুরে বলতে লাগল, আনতে বারণ করুন স্যার।