অনেকক্ষণ নীরবতা।
তারপর লাবণি বলল, একটা কথা জিগ্যেস করব?
করো, করো
লেক টাউনে এত বড় বাড়ি থাকতে আপনি কেন এই ওল্ড-এজ হোমে?
তুমি কিছু শোনোনি?
কী শুনব?
তোমার বন্ধু ছুটকি, মানে নন্দিনী তোমাকে কিছু বলেনি? ওর সঙ্গে অনেকদিন আমার যোগাযোগ নেই।
আমি যার গর্ভধারিণী সে-ই আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। এরপর সরোজিনী যা বলে গেলেন তা মোটামুটি এইরকম। লাবণি চলে আসার পর কল্পনা মীরচন্দানি নামে একটা সিন্ধি মেয়েকে অরিজিৎ বাড়িতে এনে তোলে। কিছুদিন শান্তশিষ্টই ছিল ওরা। তারপর দিনের পর দিন পীড়ন চালিয়ে লেক টাউনের বাড়ি, ব্যাঙ্কের টাকা, লকার-টাকার সব নিজের নামে লিখিয়ে নেয়। তারপর বাড়িটাড়ি বিক্রি করে সরোজিনীকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আমেরিকায় চলে যায়। যাবার সময় বলেছিল, আমেরিকার জল-হাওয়া সরোজিনীর সহ্য হবে না, সেখানকার পরিবেশ অন্যরকম, তিনি এই বয়সে মানিয়ে নিতে পারবেন না। সেবা নিকেতন খুব ভালো ওল্ড-এজ হোম। চিকিৎসা থেকে শুরু করে খাওয়া-দাওয়া, সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা চমৎকার। যত্ন, সেবা, কোনও কিছুর ত্রুটি হবে না। মোটামুটি একটা হিসেব করে তার নাকি জীবনের জন্য যথেষ্ট টাকা এই হোমে জমা রাখা আছে। তাছাড়া বছরে এক-দুবার অরিজিতরা তো আসবেই।
বলতে বলতে বৃদ্ধার চোখেমুখে রাগ, ঘৃণা, বিতৃষ্ণা, উত্তেজনা, নৈরাশ্য, কতরকমের অভিব্যক্তি যে ফুটে উঠতে লাগল–ওরা আমাকে ঠকিয়েছে। জানো, কয়েকদিন আগে আমাকে হোম থেকে জানানো হয়েছে, যে টাকা অপুরা জমা দিয়ে গেছে তাতে আর মাত্র দুটো দিন চলবে। ওরা আমাকে সর্বস্বান্ত করে চলে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি দুহাতে মুখ ঢাকলেন। তার পিঠটা ফুলে ফুলে উঠতে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ পর মুখ থেকে হাত সরালেন সরোজিনী।
লাবণি বলল, পরশু তো আপনাকে হোম ছাড়তে হবে। তখন কী করবেন, কোথায় যাবেন, কিছু ঠিক করেছেন?
না। তবে রাস্তা আছে, গাছতলা আছে, লোকের বাড়ির রোয়াক আছে। রাতটা কোনও একটা জায়গায় কেটে যাবে। কিন্তু খিদের জ্বালাও তো থাকবে। কারও কাছে কোনওদিন হাত পাততে হয়নি। জানি না কী করব।
অনেকক্ষণ কী ভেবে লাবণি বলল, উঠুন। আমার সঙ্গে যাবেন।
কোথায়?
আমাদের বাড়িতে। সেখানেই থাকবেন। পরশু আপনাকে সঙ্গে করে এখানে একবার আসতে হবে। আপনার কী জিনিসপত্র আছে চিনিয়ে দেবেন। সেসব নিয়ে আমরা ফিরে যাব।
বিহ্বলের মতো তাকিয়ে থাকেন সরোজিনী।
সত্যের মুখোমুখি
দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় একটা ইজিচেয়ারে শরীরটা পেছন দিকে অনেকখানি হেলিয়ে দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছিলেন অধ্যাপক অনির্বাণ সান্যাল। তিনি পড়ান ইংরেজি, গল্প-উপন্যাস লেখেন বাংলায়। অধ্যাপক হিসেবে তার যথেষ্ট সুনাম, লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি আরও বেশি।
কলকাতা থেকে দেড়শো কিলোমিটার দূরের এই শান্ত, নিরিবিলি শহরে কলকাতার মর্নিং এডিশনের কাগজগুলো ট্রেনে নটার আগে পৌঁছায় না। তাই ছুটির দিন ছাড়া সকালের দিকে কাগজ পড়ার সময় পান না অনির্বাণ। তখন কলেজে যাবার তাড়া থাকে। আজ রবিবার। তাই কাগজ খুলে আয়েশ করে বসতে পেরেছেন।
মাস তিনেক হল অনির্বাণ এই শহরের একটা সরকারি কলেজে বদলি হয়ে এসেছেন। যেখানে তিনি বসে আছেন, দোতলার সেই আস্ত ফ্লোরটা ভাড়া নিয়ে একাই থাকেন। একতলার ভাড়াটেরা হল একজোড়া কপোত-কপোতী। স্বামী এবং স্ত্রী। বয়স বেশি নয়, তিরিশের নীচে। দুজনেই ব্যাঙ্ক এমপ্লয়ি, তবে আলাদা আলাদা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চে। ওদেরও ট্রান্সফারের চাকরি। বাড়িওয়ালা থাকেন শহরের অন্য এলাকায়।
নীচের তলায় ভাড়াটেরা এখন নেই। ছুটি নিয়ে কোথায় যেন বেড়াতে গেছে। মাসখানেক আগে ফিরবে না। তাই বাড়িটা একেবারে নিঝুম।
অনির্বাণের বয়স চুয়াল্লিশ পয়তাল্লিশ। রং ময়লা হলেও মোটামুটি সুপুরুষ। কোনও অদৃশ্য মেক আপ ম্যান এলোমেলো ব্রাশ চালিয়ে তার মাথায় সাদা সাদা কিছু ছোপ ধরিয়ে দিয়েছে।
বারান্দার কোনাকুনি ডান দিকে কিচেন। সেখান থেকে ঠুং ঠাং আওয়াজ আসছে। খুব সম্ভব নিতাইয়ের মা রান্না চাপিয়েছে।
হঠাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। খবরের কাগজে ডুবে ছিলেন অনির্বাণ। চমকে উঠে হাতের কাগজ নামিয়ে রেখে সামনের দিকে তাকালেন। নিতাইয়ের মা ছাড়াও অন্য একটি কাজের লোক আছে তার, শিবু। সে সারা মাসের চাল ডাল তেল মশলা-টশলা কেনার জন্য বাজারের একটা মুদিখানায় গেছে। তার তত এত তাড়াতাড়ি ফেরার কথা নয়। নীচের তলার ভাড়াটেদের কাছে ছুটির দিনে অনেকে আসেন কিন্তু তারা তো এখন নেই। তাই কারও আসার সম্ভবনা খুবই কম। অনির্বাণ নিজে আদৌ মিশুকে নন। কলেজের সহকর্মীরা আছেন ঠিকই, তবে তাঁদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা হয়নি যে, না জানিয়ে হুট করে এসে হাজির হবেন। অনির্বাণ কারওকে আসতেও বলেন না। তা হলে?
কড়া নাড়াটা চলছেই। গলার স্বর একটু উঁচুতে তুলে অনির্বাণ বললেন, নিতাইয়ের মা, দেখো তো কারা এল
রান্নাঘর থেকে যে বেরিয়ে এল তার বয়স ষাটের কাছাকাছি। পরনে নীল-পাড় সাদা শাড়ি। পিঠটা সামান্য বেঁকে গেলেও এই বয়সে বেশ চটপটে, কাজকর্মে দড়। দৌড়ে তরতর সিঁড়ি দিয়ে সে নেমে গেল।
অনির্বাণ সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। নীচে অনেকটা জায়গা জুড়ে সিমেন্টে বাঁধানো উঠোন। তারপর সদর দরজা। শিবু বেরিয়ে যাবার পর নিতাইয়ের মা খিল লাগিয়ে দিয়েছিল। এখন সেটা খুলতেই দুটি সালোয়ার-কমিজ পরা মেয়েকে দেখা গেল। বয়স কত হবে? খুব বেশি হলে আঠারো কি উনিশ। সদ্য তরুণীই বলা যায়।