এই মামলা নিয়ে চারিদিকে এত কুৎসা রটেছিল যে কারও মুখের দিকে তাকানো যেত না। আদালতে যখন লাবণিকে তলব করা হত, তার মনে হত আগুনের বলয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে।
শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সটা হয়ে গেল।
তারপর অনেকদিন লাবণি বাড়ি থেকে বেরুত না। মুহ্যমানের মতো নিজের ঘরে বসে বা শুয়ে থাকত। খেতে চাইত না, ঘুমোত না। যে অভিযোগে বিবাহ-বিচ্ছেদটা হয়েছে সেটা তাকে এমন আঘাত দিয়েছে যে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কেনই বা অরিজিৎ তাকে বিয়েটা করল, আবার কেনই বা দুটো বছর পেরুতে না পেরুতে অন্য একটা মেয়ের জন্য রাঘবের মতো সরল ভালোমানুষকে তার সঙ্গে জড়িয়ে নোংরা খেলাটা খেলল সেই রহস্যের তলকূল পাওয়া যাচ্ছিল না। তার সঙ্গে বিয়েটা যে হয়েছিল তা কি অরিজিতের ক্ষণিকের মোহে?
সেই দুঃসময়ে পাশে থেকেছেন বাবা আর রাঘব। রাঘবের গায়ে তার জন্য তো কম পাক লাগেনি; তবু সে সময় পেলেই বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে চলে আসত। দুজনে তাকে বোঝাত, এত ভেঙে পড়লে চলবে না। আবার উঠে দাঁড়াতে হবে।
সময় এক আশ্চর্য জাদুকর। সব দাহ ধীরে ধীরে জুড়িয়ে দেয়। বুকের সেই দগদগে ক্ষতটা একদিন শুকিয়েও গেল।
সাতরং চ্যানেলের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে রাঘবের। সে-ই তাদের ধরাধরি করে ওদের নিউজ ডিপার্টমেন্টে লাবণির চাকরির ব্যবস্থা করে। কয়েক বছর পর সে এখন সেখানকার ডেপুটি নিউজ এডিটর। দেবনাথ মারা গেছেন। বাড়িতে এখন সে আর সোমু এবং তিনটি কাজের লোক।
.
কতক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ ট্যাক্সিটা বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। সেইসঙ্গে চালকের কণ্ঠস্বর কানে এল–দিদি, আমরা পৌঁছে গেছি। স্মৃতির অতল স্তর থেকে উঠে এল লাবণি। চোখে পড়ল সামনেই একটা বড় গেট, তার মাথায় আধখানা বৃত্তের আকারের সাইনবোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা ও সেবা নিকেতন। গেটের পর সবুজ ঘাসের একটা লন পেরুলে হলুদ রংয়ের মস্ত চারতলা বিল্ডিং।
ট্যাক্সি থেকে নেমে ভাড়া-টাড়া মিটিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল লাবণি। একটা উঁচু টুলের ওপর দারোয়ান বসে ছিল। তাকে কিছু জিগ্যেস করতে যাবে, বাঁ-দিক থেকে একজন বৃদ্ধা এগিয়ে এলেন-এসো মা। তোমার জন্যে আমি এখানে অপেক্ষা করছিলাম।
চমকে উঠল লাবণি। একসময় কী স্বাস্থ্য ছিল সরোজিনীর; এখন আর চেনাই যায় না। গাল বসে গেছে, পুরু লেন্সের চশমার ওধারে চোখ দুটো কোটরে ঢোকানো, কণ্ঠার হাড়, শীর্ণ হাতের শিরাগুলো বড় বেশি প্রকট। সারা শরীর জুড়ে ভাঙচুরের চিহ্ন। যে সরোজিনী মল্লিককে সে লেক টাউনে দেখে এসেছিল ইনি যেন তাঁর ধ্বংসস্তূপ।
সবুজ লনটা পেরিয়ে দুজনে মেইন বিল্ডিংয়ে ঢুকল। তারপর বাঁদিকের প্রশস্ত করিডর দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে ডান পাশে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন সরোজিনী। দরজায় পর্দা ঝুলছে। সেটার একপাশে কাঠের ফলকে ইংরেজিতে লেখা : অফিস। অন্য দিকে কাঠের ফলক। তাতে লেখা : ইন্দুমতী ব্যানার্জি, সুপারিনটেন্ডেন্ট।
পর্দাটা একধারে ঠেলে দেয় সরোজিনী। ভেতরে একটা গদি-আঁটা মস্ত চেয়ারে বসে আছেন বিপুল আকারের একজন মধ্যবয়সিনী। বোঝা গেল ইনিই ইন্দুমতী। তাঁর সামনে বড় টেবিল; টেবিলের এধারে কয়েকজন মহিলা বসে আছেন। ঘরের দেওয়ালগুলো জুড়ে ঢাউস ঢাউস স্টিলের আলমারি।
ইন্দুমতী সরোজিনীকে দেখতে পেয়েছিলেন। জিগ্যেস করলেন, কিছু দরকার আছে?
সরোজিনী বললেন, আমার একজন গেস্ট এসেছে। মেয়ের মতো। তাকে আমার ঘরে নিয়ে যাচ্ছি।
ঠিক আছে।
বোঝা গেল, সুপারিনটেন্ডেন্টের অনুমতি ছাড়া এখানকার আবাসিকরা বাইরের কাউকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে পারে না।
কাছেই সিঁড়ি। সরোজিনী লাবণিকে সঙ্গে করে দোতলায় একটি ঘরে চলে এলেন। একজনের পক্ষে ঘরটা বেশ ভালোই। একধারে সিঙ্গল-বেড খাট, ছোটখাটো একটা আলমারি, এক দেওয়ালে টিভি আটকানো, ব্র্যাকেটে কিছু শাড়ি, নাইটি-টাইটি। তাছাড়া দু-তিনটে চেয়ার, একটা মাঝারি টেবিল, ইত্যাদি।
লাবণিকে একটা চেয়ারে বসিয়ে নিজে বিছানায় বসলেন সরোজিনী।
লাবণি বলল, আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারব না।
সরোজিনী বললেন, জানি তুমি খুব ব্যস্ত মানুষ। আধঘণ্টার বেশি আটকে রাখব না।
লাবণি নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগল।
সরোজিনী বললেন, তোমার সঙ্গে আমি অনেক দুব্যবহার করেছি। বিশ্বাস করি তুমি সৎ, নিষ্কলঙ্ক চরিত্রের মেয়ে। তোমার বন্ধু রাঘবও তাই। তবু আদালতে হলফ করে মিথ্যে বলেছি। গ্লানি আর অপরাধবোধে কতদিন যে ঘুমোতে পারিনি! তোমাদের দুজনের কাছে। আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
লাবণি উত্তর দিল না।
সরোজিনী থামেননি–কেন আমাকে এই পাপটা করতে হয়েছিল, কেন জানো? গর্ভে আমি একটা অমানুষ, জন্তুকে ধারণ করেছিলাম। তার চাপে, তার ভয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছিল। কত মেয়ের যে ও ক্ষতি করেছে- তার গলা প্রায় বুজে এল।
অনুশোচনায় জর্জরিত বৃদ্ধাকে দেখতে দেখতে যে নিস্পৃহতা আর কাঠিন্য নিয়ে লাবণি এখানে এসেছিল সেসব ততটা তীব্র আর রইল না। নরম গলায় বলল, শান্ত হন, যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
তুমি আমাকে ক্ষমা করলে কিনা–সরোজিনী ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।
যা চুকেবুকে গেছে তা নিয়ে আমি আর ভাবি না। আপনি এ নিয়ে আর কষ্ট পাবেন না।