.
বিয়ের পর অরিজিতদের লেক টাউনের বিশাল বাড়িতে চলে এল লাবণি। প্রথম দিকে সরোজিনী ভালোই ব্যবহার করতেন, হেসে হেসে কথা বলতেন। মুখ কাঁচুমাচু করে অরিজিৎ একদিন বলেছে, দেখো, আমার যে টাইপের কাজ তাতে প্রায়ই পার্টিতে যেতে হয়। অনেককে সঙ্গ দিতে ড্রিংকও করতে হয়। দ্যাটস আ পার্ট অফ মাই জব। তুমি তো আবার পিউরিটান। রাগ করবে না তো?
লাবণি বলেছে, বাইরে যা খুশি করতে পারো। বাড়িতে এসে মাতলামি না করলেই হল। আরেকটা কথা। আমার বন্ধু রাঘবকে চেনো তো?
চিনি। তোমাদের সঙ্গেই তো মাস-কম করেছে। হঠাৎ তার কথা উঠছে কেন?
ওর মতো ছেলে হয় না। আমরা একসঙ্গে লেখালেখি শুরু করেছিলাম। আমার ধারণা, ও এখানে চলে আসতে পারে। ও চায় আমি লেখাটা যেন না ছাড়ি। সেজন্য তাড়া দিতে আসবে।
আসুক না। নো প্রবলেম
লেক টাউনে এসে যেন স্বপ্নের উড়ানে উঠে পড়েছিল লাবণি। জীবনটা মসৃণভাবেই কেটে যাচ্ছিল।
সত্যিই রাঘব কোনও কোনও দিন চলে আসত। বাংলা দৈনিকে তার চাকরি হয়ে গেছে। বলত, অমলেশদা তোর জন্যে একটা পোস্ট খালি রেখেছে। তুই গেলেই চাকরিটা হয়ে যাবে।
লাবণি বলত, চাকরি আমি করব না।
তাহলে লেখালেখিই কর। এত ভালো লিখিস। ওটা ছাড়িস না।
তাড়া দিয়ে দিয়ে চিৎ কখনও লাবণির কাছ থেকে দু-একটা লেখা আদায় করত রাঘব।
এর মধ্যে প্রায়ই উড়ো চিঠি আর অচেনা কারও ফোন আসত–যাকে বিয়ে করেছেন সেই লোকটা বদ, দুশ্চরিত্র। অনেক মেয়ের ক্ষতি করেছে। সাবধান
লাবণি পাত্তা দিত না। অরিজিতের কথাবার্তায় আচরণে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি যা আপত্তিকর।
এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ অরিজিৎ যেন বদলে যেতে লাগল। কোনও কোনও দিন তার ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যায়। দু-একদিন ফেরেই না, জিগ্যেস করলে যা জবাব দেয় সেগুলো বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ নিয়ে বেশি বললে খেপে যায়। লাবণি টের পায়, লেক টাউনে আসার পর দিনগুলো যেভাবে কাটছিল তেমনটা আর নেই। সবসময় দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ। সরোজিনীকে বললে তিনি ঝাঁঝিয়ে ওঠেন–আমাকে এসব বোলো না। কেন আমার ছেলের নামে বদনাম করছ?
লাবণি হতবাক হয়ে যায়।
একদিন অরিজিতের অফিসের একটি জুনিয়র একজিকিউটিভ, নাম তরুণ সেন, লাবণিকে ফোন করল–ম্যাডাম অফিসের বাইরে একটা প্রাইভেট বুথ থেকে ফোন করছি। আপনাকে একটা খবর দিতে চাই, আমার নামটা জানাজানি হলে ভীষণ বিপদে পড়ব।
তরুণকে ভালোই চেনে লাবণি। অফিসের কাজে অরিজিতের কাছে লেক টাউনের বাড়িতে অনেকবার এসেছে। খুবই ভদ্র, বিনয়ী। লাবণি বলল, কেউ জানবে না, আপনি বলুন। খুব টেনশন চলছিল। সে কোনও দুঃসংবাদের জন্য আপেক্ষা করতে লাগল।
তরুণ যা জানাল তা এইরকম। তাদের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের একজন জুনিয়র অফিসার, নাম কল্পনা মীরচন্দানির সঙ্গে অরিজিৎ জড়িয়ে পড়েছে। দু-একদিনের মধ্যে সপ্তাহখানেকের জন্য তারা মুম্বই যাবে। এই নিয়ে অফিসে সবাই ছি-ছি করছে। আগেও এরকম অন্য মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন স্যার। আপনাকে সাবধান করে দিলাম।
ফোনটা অফ করে বাকি দিনটা উদ্ভ্রান্তের মতো কাটিয়ে দিল লাবণি। রাত্তিরে অরিজিৎ ফিলে এলে খাওয়া-দাওয়ার পর তাকে জিগ্যেস করল, কল্পনা মীরচন্দানি কে?
অরিজিৎ চমকে উঠল। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, দ্যাটস নান অফ ইওর বিজনেস। এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
হবে। কারণ আমি তোমার স্ত্রী।
স্ত্রী! একটা থার্ড ক্লাস মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়েকে করুণা করে বিয়ে করেছিলাম। আর কোনও কথা বলবে না।
একটা মানুষের রাতারাতি এমন পরিবর্তন ঘটতে পারে, ভাবাই যায় না। লাবণি বলল, আমি কি তোমার করুণা চাইতে এসেছিলাম?
স্টপ ইট।
এরপর শুরু হল অশান্তি, তিক্ততা, চিৎকার-চেঁচামেচি, নোংরা নোংরা গালাগাল, লাবণির ওপর তীব্র মানসিক নির্যাতন। আশ্চর্য, ছেলের সঙ্গে তার মা সরোজিনী মল্লিকও গলা মেলালেন।
জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। একদিন লাবণি বলল, এই নরককুণ্ডে আমার আর এক মুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করে না।
অরিজিৎ খেপে ওঠেনি। শান্ত গলায় বলল, ভেরি গুড় ডিসিশন। চলল, কালই আমরা কোর্টে গিয়ে সেপারেশনের জন্যে একসঙ্গে অ্যাপিল করি। ব্যাপারটা পিসফুলি মিটে যাবে।
অত সহজে তোমাকে ডিভোর্স দেব না।
কী চাও—টাকা? বলো, কত দিতে হবে।
টাকা দিয়ে তুমি ডিভোর্স কিনতে পারবে না। তোমাকে আমি একটা শিক্ষা দিতে চাই।
লেক টাউন থেকে বাঁশদ্ৰোণীতে বাবার কাছে চলে এল লাবণি।
মানুষ যে কত নীচের স্তরে নামতে পারে অরিজিতরা এবার দেখিয়ে দিল। ওরা ডিভোর্সের মামলা করল। বিবাহ-বিচ্ছেদের কারণ হিসেবে লাবণির ব্যাভিচারের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। রাঘব যে লেক টাউনে লাবণিকে লেখাটেখার জন্য তাড়া দিতে যেত সেটা ওরা কাজে লাগিয়েছে।
সরোজিনী মল্লিক আদালতে দাঁড়িয়ে হলফ করে বলেছেন, অরিজিৎ যখন বাড়িতে থাকত, দুপুরের দিকে প্রায়ই রাঘব আসত। অতবড় বাড়িতে তিনি তখন তার ঘরে ঘুমোচ্ছেন। কোনও কোনও দিন ঘুম না এলে এধারে-ওধারে হয়তো ঘুরছেন, হঠাৎ রাঘবের সঙ্গে লাবণিকে জঘন্য আপত্তিকর অবস্থায় দেখতে পেতেন। বকাবকি করেও ছেলের বউকে তিনি শোধরাতে পারেননি। অগত্যা ছেলেকে জানাতে হয়েছে, ইত্যাদি।
স্তম্ভিত হয়ে গেছে লাবণি। একজন ভদ্র বংশের বয়স্ক মহিলা শপথ নিয়ে কোর্টে মিথ্যা বলতে পারেন, ভাবা যায় না।