না না, যে রেস্তোরাঁর কথা বলছি, সেখানে বার নেই।
না থাক। আমি যাকে একবার মাত্র দেখেছি, তার সঙ্গে রেস্তোরাঁয় যাব? ভাবলেন কী করে?
এক্সট্রিমলি সরি। ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করবেন। তা হলে আপনি যেখানে কমফর্ট ফিল করবেন সেখানেই আমাদের দেখা হবে।
.
মনে আছে, এক বৃহস্পতিবার ফোন করেছিল অরিজিৎ। তার ঠিক দুদিন বাদে রবিবার বিকেলে সে তাদের বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে এসে হাজির। বিতৃষ্ণায়, রাগে, গা রি-রি করে উঠেছে লাবণির। ভেবেছিল ঘাড় ধরে বের করে দেয়। কিন্তু পারা যায়নি। বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে হয়েছে। চা-মিষ্টি খেতে খেতে সে বাবার সঙ্গে ফুরফুরে মেজাজে গল্প করেছে। সোমুর ঘরে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে হেসে কথা বলেছে। যাবার সময় বাবার কানে যাতে না যায়, তাই গলা নামিয়ে বলে গিয়েছিল, বলেছিলাম দেখা করব, করলাম তো—
অরিজিৎকে, দেবনাথের খুব ভালো লেগেছে। সে চলে যাবার পর তিনি বললেন, ছেলেটা চমৎকার। কী সুন্দর ব্যবহার।
সেই শুরু। তারপর ছুটির দিনে তো বটেই, সপ্তাহের অন্য দিনেও সন্ধের পর আসতে লাগল অরিজিৎ। দেবনাথের সঙ্গেই গল্প করত বেশি।
প্রথম প্রথম তাকে দেখলে মুখচোখ শক্ত হয়ে উঠত লাবণির। কোন উদ্দেশ্য মাথায় পুরে সে লেক টাউন থেকে বাঁশদ্ৰোণীতে আসত তাই নিয়ে যথেষ্ট ধন্দ ছিল তার। কবে থেকে সংশয়, অস্বস্তি, বিরক্তি কেটে যাচ্ছিল খেয়াল নেই।
দেবনাথকে জানিয়ে দু-চারদিন লাবণিকে নিয়ে বেড়াতেও বেরিয়েছে অরিজিৎ। লাবণি খুব একটা আপত্তি করেনি। মনে হচ্ছিল অরিজিৎকে বিশ্বাস করা যায়। বাইরে বেরুলে কোনও দিনই বড় হোটেলে বা রেস্তোরাঁয় তাকে নিয়ে যায়নি। রাস্তার ধারে খুব সাধারণ চায়ের দোকানে ঢুকে চা টোস্ট কি অন্য কিছু খেত।
ততদিনে তারা একজন আরেকজনকে তুমি করে বলতে শুরু করেছে। চা-টা খেতে খেতে মজা করে লাবণি বলল, তোমরা তো সোসাইটির উঁচু স্তরের মানুষ। হঠাৎ মিডল ক্লাসের লেভেলে নেমে আসতে চাইছ যে
অরিজিৎ হাসত, উত্তর দিত না।
এদিকে আগের মতো আর লেখালেখিতে লাবণির তেমন মন নেই। লেখার জন্য তথ্য জোগাড় করতে কত জায়গায় ছুটত, ন্যাশনাল লাইব্রেরি ছাড়াও কলকাতার অন্য অনেক পুরোনো গ্রন্থাগারে গিয়েও বই ঘাঁটাঘাঁটি করত। অরিজিৎ তাদের বাড়িতে সেই যে প্রথম এসেছিল তার কিছুদিন পর থেকে লেখার উৎসাহ বা উদ্যম যেন কমে আসছিল। কাগজের অফিসগুলোতেও আগের মতো ততটা যেত না।
রাঘব ফোনে, কখনও কখনও লাবণিদের বাড়িতে এসে রাগারাগি করত।–দ্যাখ, আমাদের চাকরির সুযোগ এসে গেছে। অমলেশদার কথামতো লেখালেখিটা যদি সিরিয়াসলি না করিস তোর ওপর তার ইমপ্রেশনটা কী হবে? ওদিকে বিজয়দাও আমি গেলে তোর কথা জিগ্যেস করেন। সুযোগ কিন্তু বার বার আসে না।
রাঘব যে তার এত প্রিয় বন্ধু, এত হিতাকাঙ্ক্ষী, অরিজিৎ যে তাদের বাড়ি আসে, এ খবরটা তখনও তাকে দেয়নি লাবণি। রাঘবের তাড়ায় মাঝে মাঝে কাগজের অফিস দুটোতে যেত সে; অমলেশ বা বিজয়ের ফরমাশ মতো দু-একটা লেখা লিখে দিত।
এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন রাত্তিরে খাওয়া দাওয়ার পর দেবনাথ তার ঘরে এলেন। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, তোর সঙ্গে দরকারি কথা আছে খুকু
লাবণি উৎসুক চোখে তাকিয়েছে। কী কথা বাবা?
অরিজিৎকে তো বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি। বেশ ভদ্র, ভালো ছেলে। উচ্চশিক্ষিত, লাইফে এস্টাব্লিশড। অরিজিৎ আমার কাছে একটা প্রোপোজাল দিয়েছে।
কীসের পোপোজাল?
ও তোকে বিয়ে করতে চায়।
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর লাবণি বলল, একটা কথা ভেবে দেখেছ বাবা?
কী?
তোমার বয়স হয়েছে। রিটায়ারমেন্টের আর দু-তিন বছর বাকি। মানুষ তো অমর নয়। আমি খারাপের দিকটা ভাবছি। ধরো আমার বিয়েটা হল আর হঠাৎ তোমার কিছু হয়ে গেল, সসামুর তখন কী হবে, কে তাকে দেখবে?
অরিজিতের সঙ্গে সে সব কথাও আমার হয়েছে। আমার কিছু হলে সে সোমুর দায়িত্ব নেবে।
বাবার সঙ্গে অরিজিতের এত সব কথা হয়েছে, আগে জানতে পারেনি লাবণি। সে চুপ করে থাকে। আগের মতো সংশয়, কাঠিন্য না থাকলেও অরিজিৎ সম্পর্কে বরাবর একটা দ্বিধা থেকে গেছে তার। সে তাদের বাড়ি আসে, তার সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু বিয়ে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সুন্দরী মেয়ের কি খুবই অভাব? অরিজিৎ আঙুল তুলে একটু ইশারা করলে লাবণির চেয়ে অনেক বেশি রূপসি, অনেক বেশি বিদুষী, অভিজাত পরিবারের মেয়েদের বাবারা তাদের লেক টাউনের বাড়ির সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে যেত। লাবণির মতো সাদামাটা, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ের মধ্যে কী পেয়েছে অরিজিৎ? এই ধন্দটা কিছুতেই পুরোপুরি কাটছে না।
দেবনাথ বললেন, কী রে, কিছু বলছিস না যে!
আমাকে কদিন ভাবতে দাও।
শেষ পর্যন্ত বিয়েটা হয়েই গেল। বিয়ের অনুষ্ঠানটা লাবণি আর অরিজিতের বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনরা হইহই করে মাতিয়ে দিল। শুধু দুজন বাদ! রাঘব আর নন্দিনী। রাঘব বলেছে, আর কদিন ওয়েট করলে চাকরিটা হয়ে যেত। চাকরি হলে পায়ের তলায় শক্ত জমি পাওয়া যায়। সেটা একটা বড় শক্তি। নন্দিনী বলেছে, অপুদাকে বিয়ে করলি। দেখা যাক সে হয়তো কোনও ইঙ্গিত দিয়ে চেয়েছিল, লাবণি শুনেও শোনেনি।