এটাও আপনার নজরে পড়েছে?
পড়বে না? মেয়েটা তত বেশি কথা বলে। আপনি একেবারে চুপচাপ।
আমার শুনতে বেশি ভালো লাগে।
ইউ আর ভেরি স্পেশ্যাল।
আপনার সঙ্গে যখন পরিচয় হল, তখনই কিন্তু জানিয়ে দিয়েছিলাম, আমি মিডল ক্লাস ফ্যামিলির সামান্য একটি মেয়ে।
কে সামান্য, কে অসামান্য, মুখ দেখে খানিকটা বুঝতে পারি।
ও বাবা, আপনার এই গুণটাও আছে।
অরিজিৎ হাসল।
কেটারারের উর্দিপরা বেয়ারারা খাবার এনে প্লেটে প্লেটে দিয়ে যেতে লাগল। দুই রোয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নন্দিনী অনবরত বলতে লাগল, একে ফ্রাই দাও, ওর পাত খালি, পোলাও আর কোর্মা নিয়ে এসো ইত্যাদি।
হই হই করে খাওয়া দাওয়া চলছে। খেতে খেতে অরিজিৎ অন্য সবার সঙ্গে গলা মেলাচ্ছে, আবার কণ্ঠস্বর নামিয়ে লাবণির সঙ্গে দু-একটা কথা বলছে।
খাওয়া শেষ হলে সবাই নীচে নেমে এল। তখনও বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হয়নি। নন্দিনীর মা-বাবার সঙ্গে দেখা করে লাবণিরা সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে বাইরের রাস্তায় চলে এল। যে সাতটা গাড়ি ভাড়া করে তারা এসেছিল সেগুলো লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এগুলোই তাদের সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
নন্দিনী বন্ধুদের রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল। সঙ্গে অরিজিৎ এসেছে। সবাই যখন একে একে গাড়িতে উঠছে, সেই ফাঁকে অরিজিৎ লাবণিকে বলল, আবার কবে দেখা হবে?
লাবণি স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল। এইরকম কোনও অনুষ্ঠানে আপনাকে আর আমাকে যদি ইনভাইট করা হয় দেখা হলেও হতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা অ্যাট অল আছে বলে মনে হয় না। বলেই গাড়িতে উঠে গেল।
.
বাড়ি ফিরে শুতে শুতে বারোটা বেজে গেল। কিন্তু ঘুম আসছে না। বারবার অরিজিতের মুখটা মনে পড়ছে। এত সুপুরুষ, ম্যানেজমেন্টে চোখ-ধাঁধানো রেজাল্ট, দুর্দান্ত কেরিয়ার, পয়সাওয়ালা বাড়ির একমাত্র ছেলে। সবে তো সেদিনই আলাপ হয়েছে। দু-চারটের বেশি কথা হয়নি। তার সম্বন্ধে অরিজিতের এত আগ্রহ কেন? উটকো চিন্তাটা মাথা থেকে জোর করে বের করে দিতে সময় লাগল লাবণির। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন ঘুম ভাঙল বেশ বেলায়। মুখ-টুখ ধুয়ে চা খেয়ে লেখার টেবিলে গিয়ে বসল লাবণি। বাংলা কাগজের অমলেশদা আর ইংরেজি ডেইলির নিউজ এডিটর বিজয়দা অর্থাৎ বিজয় পালিত তাদর দুই কাগজের জন্য দুটো টপিক দিয়েছেন। লেখা দুটো চার কি পাঁচদিনের ভেতর দিতে হবে।
আগে থেকেই ঠিক করা আছে, বাংলা কাগজের লেখাটা প্রথমে শেষ করে ইংরেজি কাগজেরটায় হাত দেবে।
কাগজ-কলম-টলম টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করে মনে মনে লেখাটা শুরু থেকে শেষ অবধি মোটামুটি সাজিয়ে নিয়ে শুরু করতে যাবে, দেবনাথ দরজার বাইরে থেকে বললেন, বেরুচ্ছি রে। পৌনে দশটা বাজে। আজ অফিসে নির্ঘাত লেট। কাল রাত্তিরে তুই তখন বিয়েবাড়িতে, সোমুটার জ্বর এসেছিল। মালতী আছে, তবু তুই দু-একবার গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসিস।
আসব, আসব। তুমি ভেবো না।
দেবনাথ চলে গেলেন।
তারপর মাত্র দশ-বারো লাইন লিখেছে লাবণি, হঠাৎ রাঘবের ফোন-কাল নন্দিনীদের বাড়ি থেকে এত রাত্তিরে ফেরা হয়েছে। এখনও বিছানায় চিতপাত হয়ে পড়ে আছিস নাকি!
লাবণি বলল, না রে না, উঠে পড়েছি।
অমলেশদা খুব ভালো মানুষ, সিমপ্যাথেটিক, কিন্তু সময়মতো লেখা না দিলে ফায়ার হয়ে যান। তোর আর আমার লেখা পরশুদিন দিতে হবে। মনে থাকে যেন।
রাঘবের মতো বন্ধু হয় না। লাবণি বলল, সেই লেখাটা নিয়েই তো বলছি।
গুড ছাড়ছি।
আরও কয়েক লাইন লেখার পর আবার ফোন। এবার নন্দিনী। রীতিমতো অবাকই হল লাবণি। কী রে, বিয়েবাড়িতে এত ব্যস্ততা, তার মধ্যে হঠাৎ ফোন করলি? এনিথিং আর্জেন্ট?
নন্দিনী বলল, কাল খেতে বসে ফিসফিস করে কী বলছিল রে অপুদা?
তুই লক্ষ করেছিস?
আমি একা কেন, আরও কেউ কেউ দেখেছে।
অরিজিৎ যা যা বলেছে, সব জানিয়ে দিল লাবণি।
নন্দিনী বলল, তোকে একটা ব্যাপার জানানো দরকার। অপুদার মা আমার আপন পিসি নয়। আমাদের সঙ্গে লতায় পাতায় সম্পর্ক। তবে ঘনিষ্ঠতা আছে। আমাদের বাড়ির সব ফাংশনে ওরা আসে, ওদের বাড়ির ফাংশনে আমরা যাই। অপুদার সব ভালো, তবে সুন্দরী মেয়ে দেখলে কাত হয়ে পড়ে। এটা ওর ডিজিজ। বলেই লাইনটা কেটে দিল।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে লাবণি। তারপর ফের লিখতে লাগল। কাল রাত্তিরেই তো অরিজিতের চিন্তাটা খারিজ করে দিয়েছে। এ নিয়ে আর ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই।
.
মালিনীর বিয়ের পর দশ-বারোটা দিন কেটে গেছে। দুপুরবেলা ড্রইংরুমে ডিভানে কাত হয়ে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছিল লাবণি, ল্যান্ড লাইনের ফোনটা বেজে উঠল। অন্যমনস্কর মতো সেটা তুলে হ্যালো বলতেই ওধার থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। চমকে উঠে বসল সে-আপনি। আমার ফোন নাম্বার পেলেন কী করে?
ওটা পাওয়া কি খুব কঠিন।
কতটা সহজ?
আপনি যে কাগজ দুটোয় লেখেন, সেই দুটোতেই আমার জানাশোনা কেউ কেউ কাজ করে। লেখার সঙ্গে ফোন নাম্বার, অ্যাড্রেস দিয়েছেন। এটাই নাকি নিয়ম। বুঝতেই পারছেন তাদের কারও কাছ থেকে দুটোই জেনে নিয়েছি। সে যাক আমার ইচ্ছে আপনার সঙ্গে একদিন দেখা হোক। যদি বলেন, ভালো কোনও রেস্তোরাঁয় টেবল বুক করি।
মুখটা কঠিন হয়ে উঠল লাবণির।অরিজিত্ত্বাবু, অনেক মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ভ্যালুজ নষ্ট হয়ে গেছে; তারা বদলে গেছে। আমরা কিন্তু পুরোনো ভ্যালুগুলো ধরেই আছি। বার-কাম-রেস্তোরাঁয় কোনওদিনই যেতে পারব না।