এদিকে বাবা আর মা মিনিমাম পঁচিশবার তোদের কথা জিগ্যেস করেছে।
মহিলা বললে, দাদা-বউদি কোথায় রে?
নন্দিনী বলল, দোতলায়। যেখানে বর আর বরযাত্রীরা এসে বসবে সেই জায়গাটা ঠিকমতো সাজানো হয়েছে কিনা, সার্ভে করতে গেছে।
মহিলা তার ছেলেকে বললেন, চল অপু, দাদা-বউদির কাছে যাই।
অপু বলল, তুমি যাও। আমি পরে আসছি।
মহিলা চলে গেলেন। অপু রাঘব, সুধেন্দু, গোপালের দেখিয়ে বলল, এদের তো চিনতে পারলাম না।
নন্দিনী বলল, এরা আমার বন্ধু। একসঙ্গে আমরা জার্নালিজম মাস কমিউনিকশন পড়তাম।
আরে বাবা, একসঙ্গে আমি এত জার্নালিস্ট আগে আর কখনও দেখিনি।
সুধেন্দু বলল, পাশ করেছি, কিন্তু এখনও কেউ জার্নালিস্ট হইনি। হবার চেষ্টা করছি।
লক্ষ্য করেছি এখানে বেশ আড্ডা চলছে। আমিও খুব আড্ডাবাজ। বসতে পারি?
সুদর্শন, ঝকঝকে, মিশুকে যুবকটিকে সবার ভালো লেগে গিয়েছিল। তারা হই হই করে উঠল–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই
অপু বসে পড়ল। নন্দিনী বলল, অপুদা, আগে তোমাদের পরিচয়টা করিয়ে দিই
অপু বলল, দরকার নেই। ওটা আমি নিজেই করে নিচ্ছি। বলে সুধেন্দু, গোপা-টোপাদের দিকে তাকাল। –আমার ডাকনাম অপু। ভালো নাম অরিজিৎ মল্লিক। লেক টাউনে আমাদের ছোট একটা বাড়ি আছে, সেখানে আমার মা সরোজিনী মল্লিক আর আমি থাকি। একটা ছোট চাকরি করি। ব্যস–
নন্দিনী দুহাত নাড়তে নাড়তে চেঁচামেচি করতে লাগল। তোরা বিশ্বাস করিস না। লেক টাউনে অপুদাদের বিশাল তেতলা বাড়ি। ও আমেদাবাদের আইআইএম থেকে এমবিএকরেছে। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির খুব বড় পোস্টে আছে।
এনাফ, এনাফ। এবার চুপ কর। নন্দিনীকে থামিয়ে দিয়ে একে একে সুধেন্দুদের নাম-টাম জেনে নিতে নিতে সবার শেষে লাবণির দিকে তাকাল।
লাবণি লক্ষ্য করেছে এতক্ষণ অন্য বন্ধুদের সঙ্গে অরিজিৎ কথা বলছিল ঠিকই, তবে বারবার তার চোখ এসে পড়ছিল তারই দিকে। সেই সময়ে লাবণি ছিল খুবই সুন্দরী, সপ্রতিভ। সে নিজেও কি অরিজিৎকে দেখছিল না?
অরিজিৎ হাসল, এবার আপনার কথা শুনি।
আমি লাবণি। আমাদের খুব সাধারণ মিড ক্লাস ফ্যামিলি। গলা উঁচু করে বলার মতো তেমন কিছুই নেই।
অরিজিৎ কয়েক লহমা তাকিয়ে রইল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সরিয়ে নিল।
তারপর আজ্ঞা দারুণ জমে উঠল। কতরকম টপিক-পলিটিকস, ক্রিকেট, ফুটবল, সিনেমা, স্টেজ, আন-এমপ্লয়মেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিজনেস ম্যানেজমেন্টের তুখোড় ছাত্র অরিজিৎ দেশের তো বটেই, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কত বিষয়েই যে জানে! বলার ভঙ্গিটাও চমৎকার। মুগ্ধ হয়ে শোনার মতো।
আচ্ছা যখন জমজমাট, সেইসময় কে এসে খবর দিল, ছুটকি, বর, বরযাত্রীরা কখন এসে গেছে। এখনি বিয়ে শুরু হবে। শিগগিরি বন্ধুদের নিয়ে আয়। বিয়ে দেখবি না!
বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে দোতলায়; ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে একটা সামিয়ানার ভেতর। আড্ডায় সবাই এতটা মেতে ছিল যে কখন মালিনীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কেউ খেয়াল করেনি। নন্দিনী প্রায় লাফিয়ে উঠে বন্ধুদের সঙ্গে অরিজিৎকে তাড়া দিতে দিতে দোতলায় নামিয়ে নিয়ে এল।
মুহুর্মুহু উলুধ্বনি, শাঁখের আওয়াজ আর পুরোহিতদের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে বিয়ের কাজ চলছে। সামিয়ানার চারপাশ নানা বয়সের মেয়েদের ভিড়ে ঠাসা। চলছে তাদের কলকলানি, হাসাহাসি। পুরুষরা একটু দূরে থোকায় থোকায় দাঁড়িয়ে নানা রঙ্গকৌতুকে হেসে হেসে উঠছে।
নন্দিনীর মা-বাবা এখানেই ছিলেন। নন্দিনী তাদের সঙ্গে বন্ধুদের পরিচয় করিয়ে দিল। সবাই প্রণাম করতে যাচ্ছিল, নন্দিনীর বাবা হাত তুলে তাদের থামিয়ে দিয়ে হেসে হেসে বললেন, এতজনের প্রণাম নিতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে। প্রণামগুলো ভোলা রইল, পরে একদিন হবে। ছুটকি, বিয়ে শেষ হতে মাঝরাত পেরিয়ে যাবে। তোর বন্ধুদের আগেই খাইয়ে দিস। ওদের তো বাড়ি ফিরতে হবে। লাবণিদের বললেন, এটা তোমাদের দিদির বিয়ে। আনন্দ করে খেয়ো। যার যেটা ইচ্ছে, চেয়ে নেবে কিন্তু
কিছুক্ষণ বিয়ের অনুষ্ঠান দেখার পর নন্দিনী বন্ধুদের নিয়ে ছাদে চলে এল। অরিজিৎও সঙ্গে এসেছে। বলল, আলাপ-পরিচয় হল। সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে খাওয়া যাবে। তাই এসে পড়লাম। আপত্তি নেই তো?
সবাই হই হই করে উঠল। একেবারেই না। আপনার কোম্পানি পাওয়া-ইটস আ প্লেজার।
লাবণি কিছু বলল না। নিঃশব্দে লক্ষ করতে লাগল।
ছাদের মস্ত প্যান্ডেলের বেশির ভাগটা জুড়ে টেবিল চেয়ার পেতে খাওয়ানোর ব্যবস্থা।
অন্য নিমন্ত্রিতদের মধ্যে অনেকেই এসে গেছে। প্যান্ডেলের এক ধারে মুখোমুখি লম্বা দুটো রো ফাঁকা রয়েছে। নন্দিনী বন্ধুদের সেখানে নিয়ে বসাল।
একটা রোয়ের শেষ দিকে বসেছে লাবণি। তার পর তিন চারটে খালি চেয়ার। আচমকা অরিজিৎ লাবণির ঠিক পাশের চেয়ারটায় এসে বসল।
অরিজিৎ কি লক্ষ রাখছিল তার পাশের চেয়ারটা কেউ দখল করেনি, তাই চটপট এসে বসে পড়ল। ওর মাথায় কি কোনও মতলব ঘুরছে? মনটা কেমন ঘোলাটে হয়ে গেল। সেই সঙ্গে একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। আবার অল্প অল্প ভালোও লাগছে। কেন লাগছে লাবণি বলতে পারবে না।
গলা অনেকটা নামিয়ে অরিজিৎ বলল, তেতলার হলঘরে, আমরা সবাই যখন হইচই করে আড্ডা দিচ্ছিলাম, আপনি কিন্তু দুচারটের বেশি কথা বলেননি।