সেই শুরু। তারপর বছরখানেক এভাবেই চলল। লাবণি আর রাঘবের লেখা সম্পর্কে বাংলা দৈনিকটির বার্তা-সম্পাদক অমলেশ সান্যালের ভালো ধারণা তো ছিলই, ওদের তিনি খুব পছন্দও করতেন। একদিন তিনি একটা সুখবর দিলেন। বছর দেড়েকের মধ্যে নিউজ ডিপার্টমেন্টের পাঁচজন সিনিয়র সাংবাদিক অবসর নিতে চলেছেন। তাঁদের শূন্যস্থানগুলি পূ রণ করার জন্য নতুন লোক নেওয়া হবে। তিনি কাগজের কর্তৃপক্ষকে লাবণি আর রাঘবের নাম সুপারিশ করলেন। ওদের চাকরি নিশ্চয়ই হয়ে যাবে।
কিন্তু কাগজের চাকরিটা করা হল না লাবণির। মিডিয়া ছিল তার পাখির চোখ। হঠাৎ এমন কিছু ঘটনা ঘটল যাতে আসল নিশানাটা বহুদূরে প্রায় মিলিয়ে গেল। জীবনটা তোলপাড় হতে হতে তাকে টেনে নিয়ে গেল অন্য এক দিকে, যার জন্য সে আদৌ প্রস্তুত ছিল না।
মাস কম-এ তাদের ব্যাচের নন্দিনীর দিদি মালিনীর সে বছর বিয়ে ঠিক হয়েছে। নন্দিনী বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে নেমন্তন্ন তত করলই, সেই সঙ্গে শাসিয়েও দিল, যে তার দিদির বিয়েতে যাবে না, ইহজীবনে সে তার মুখদর্শন করবে না।
হাজরা রোডে নন্দিনীদের বিরাট চারতলা বাড়ি। সামনের দিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। সেখানে নিমন্ত্রিতদের বসার ব্যবস্থা। মস্ত ছাদটা ঘিরে বিশাল প্যান্ডেল।
লাবণিরা ঠিক করেছিল, কয়েকটা গাড়ি ভাড়া করে বন্ধুরা একসঙ্গে বিয়ে বাড়িতে আসবে সন্ধের পর পর তারা এসেও গেল। নন্দিনীদের বাড়িটা অজস্র ফুল আর নানা রংয়ের আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে। আকুল করা সুরে সানাই বেজেই চলেছে।
গিফট বক্স আর প্যাকেট-ট্যাকেট নিয়ে লাবণিরা গাড়িগুলো থেকে নেমে বাড়ির ভেতরে সামিয়ানার কাছাকাছি চলে এসেছে, ছুটতে ছুটতে নন্দিনী এসে হাজির। হাসতে হাসতে বলল, তোরা এসেছিস! কী ভালো যে লাগছে! আয় আয়–
কলবল করতে করতে সবাই এগিয়ে চলল। নন্দিনী তাদের তেতলায় মস্ত এটা হলঘরে নিয়ে এল। এখানেও গেস্টদের বসার জন্য চমৎকার বন্দোবস্ত। বলল, বোস্ বোস্। কী দিতে বলব? কফি, কাবাব-টাবাব, না সরবত?
কেউ বলল না। বলল, ওসব পরে হবে। আগে দিদির কাছে নিয়ে চল–
তেতলারই একটা বিশাল ঘরের পুরো মেঝেটা দামি কার্পেট দিয়ে মোড়া। মাঝখানে ফুলের ঝালর দিয়ে সাজানো চাদোয়ার তলায় যে বসে আছে, সে যে মালিনী, দেখামাত্রই বোঝা যায়। পরনে মেরুন রংয়ের মহার্ঘ বেনারসি। তার গলা, কান, হাত, আঙুলের গয়নাগুলো থেকে হীরের ঝলক ঠিকরে ঠিকরে বেরুচ্ছে। তাকে ঘিরে ডজন ডজন কিশোর, তরুণী এবং কয়েকজন বয়স্ক মহিলা অবিরত কলর কর করে চলেছে। কোনও মজার কথায় একসঙ্গে সবাই গলা মিলিয়ে হেসে উঠছে। বিয়ের কনেকে ঘিরে যেমন হয় আর কী।
ঘরের চারপাশে ফ্লাওয়ারভাসের রজনীগন্ধা, গোলাপের তোড়া। ফুলে আর মেয়েদের পোশাক থেকে উঠে আসা পারফিউমের গন্ধে সারা ঘর ম-ম করছে।
মেয়েদের ভিড় সরিয়ে নন্দিনী সবান্ধবে মালিনীর কাছে চলে এল–দিদি, এরা আমার বন্ধু। একসঙ্গে মাসকম করেছি।
মিষ্টি হেসে মালিনী বলল, তোমরা এসেছ, খুব আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু আজ এমন একটা দিন যে জমিয়ে গল্প করব তার উপায় নেই।
সুধেন্দু বেশ হাসিখুশি, আমুদে ধরনের ছেলে। বলল, না, না, আজ আপনার এমন সময় নেই যে গল্প করবেন। দ্বিরাগমনে যখন আসবেন, নন্দিনী যদি আমাদের ইনভাইট করে জামাইবাবু আর আপনার সঙ্গে চুটিয়ে আড্ডা দেব।
মালিনী ছোটবোনের দিকে তাকাল। এই ছুটকি, ওদের সেদিন কিন্তু আসতে বলবি।
নন্দিনীর ডাকনাম যে ছুটকি, সেই প্রথম জানল তার বন্ধুরা। ঠোঁট টিপে তার দিকে তাকিয়ে সবাই হাসতে লাগল।
এমন একটা বিদঘুটে ডাকনাম বন্ধুরা জেনে ফেলায় অস্বস্তি হচ্ছিল নন্দিনীর। কোনওরকমে একটু হাসল সে।
দিদি, হ্যাপি হ্যাপি হ্যাপি ম্যারেড লাইফ হই হই করে এই ধরনের শুভেচ্ছা জানিয়ে গিফটগুলো দিয়ে সুধেন্দু, গোপা, লাবণিরা হলঘরে ফিরে এল। সঙ্গে নন্দিনীও।
এদিকে হলঘর প্রায় ভরে গেছে। কয়েকটা বেয়ারা ট্রেতে কফি, চা, শরবত, কাবাব, চিকেন পাকোড়া, কাজু, পেস্তা ইত্যাদি নিয়ে ভিড়ের মধ্যে চক্কর দিচ্ছে। গেস্টরা যে যার ইচ্ছামতো কফি-টফি তুলে নিচ্ছে। লাবণিরাও নিল। খেতে খেতে লঘু মেজাজে গল্প চলছে।
গোপা নন্দিনীকে বলল, তুই এখানে বসে আড্ডা মারছিস কেন? দিদির বিয়ে, কাজ কর গিয়ে
তোদের অ্যাটেন্ড করাই আমার কাজ। অন্য কাজের জন্যে ডজন ডজন লোক আছে।
ঠিক আছে, মনপ্রাণ দিয়ে অ্যাটেন্ড কর।
আ যখন তুমুল হয়ে উঠেছে তখন কেউ ডেকে উঠল, ছুটকি—
দেখা গেল দোতলা থেকে প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায় পৌঁছে যাওয়া একজন সুশ্রী মহিলা এবং একটি যুবক, বয়স তিরিশের নীচেই হবে, উঠে এল। যুবকটির পরনে ধাক্কাপাড় ধুতি, তসরের পাঞ্জাবি, হাতে বিদেশি রিস্টওয়াচ, পাঞ্জাবির বোতামগুলোতে হীরে বসানো। এমন সুন্দর মানুষ কচ্চিৎ কখনও চোখে পড়ে।
গোপা, সুধেন্দু, মঞ্জুশ্রীরা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল।
এদিকে নন্দিনী প্রায় লাফিয়ে উঠেছে।–পিসি, অপুদা, তোমাদের তো সন্ধের আগে আসার কথা। এত দেরি করলে কেন?
মহিলা আর যুবকটির সঙ্গে নন্দিনীর কী সম্পর্ক, মোটামুটি বোঝা গেল।
অপু বলল, কী করে আসব? বেরিয়েছি পাঁচটায়। রাস্তায় যা জ্যাম ভাবতে পারবি না। ভিআইপি রোডে গাড়ি এত বেড়েছে যে নড়াচড়া করাই মুশকিল।