খাওয়া শেষ করে হাউসকোট ছেড়ে, শাড়ি-টাড়ি পরে, কিছু টাকা ব্যাগে পুরে বেরিয়ে পড়ল লাবণি। তাদের বাড়িটা প্রায় বড় রাস্তার ওপরে। সেখানে আসতেই একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কোথায় যেতে হবে, ট্যাক্সিওয়ালাকে জানাতেই গাড়িটা গড়িয়ার দিকে দৌড় শুরু করল।
কয়েক বছরের মধ্যে শহরের এই এলাকাটা আগাগোড়া বদলে গেছে। রাস্তার দুধারে আদ্যিকালের যেসব বাড়ি, ডোবা, পানাপুকুর, ঝোপঝাড় ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। লাইন দিয়ে এখন চোখধাঁধানো হাইরাইজ, আঁ-চকচকে কত যে শো-রুম, ব্যাঙ্ক, নানা ধরনের অফিস ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষজন বেড়ে গেছে বহুগুণ; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রাইভেট কার, অটো, বাস, মিনি। পাশের টালির নালার ওপর দিয়ে অবিরল ছুটে চলেছে মেট্রো রেল।
জানলার বাইরে অন্যমনস্কর মতো তাকিয়ে আছে লাবণি। রাস্তায় গাড়ি-টাড়ি, লোকজনের ভিড়, কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছিল না। কী এক উজান টানে সে ন-দশ বছর আগের দিনগুলোতে ফিরে যাচ্ছিল।
.
বাঁশদ্রোণীর বাড়িতে তখন তারা তিনজন। বাবা দেবনাথ মজুমদার, ছোট ভাই সোমু আর সে। যে তিনটি কাজের লোক এখন রয়েছে, তখনও তারাই ছিল। এর কিছুদিন আগে মায়ের মৃত্যু হয়েছে।
দেবনাথ রাজ্য সরকারের একটা ডিপার্টমেন্টের ছোটখাটো অফিসার। রিটায়ারমেন্টের তখনও দুতিন বছর বাকি।
লাবণি ছাত্রী হিসেবে যথেষ্ট ভালো মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক তিন-চারটে লেটার নিয়ে ফাস্ট ডিভিশন, একটা নামকরা কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স নিয়ে হাই সেকেন্ড ক্লাস। রেজাল্টগুলো উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
দেবনাথের ইচ্ছা ছিল মেয়ে ইংরেজিতে এম.এ.-টা করে বি.এড-টাও করে নিক। তারপর স্কুল সার্ভিস কমিশনে বসুক। তুড়ি মেরে পাশ করে স্কুলের চাকরি পেয়ে যাবে। স্কুল টিচারদের মাইনে টাইনে খুবই ভালো। তা ছাড়া পার্মানেন্ট সার্ভিস। ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত। রিটায়ারমেন্টের পর পেনশন।
কিন্তু, তখন কি তারও আগে থেকে মিডিয়ার রমরমা শুরু হয়েছে। একদিকে নতুন নতুন কাগজ বেরুচ্ছে, অন্যদিকে টেলিভিশনে কিছুদিন পর পরই নতুন চ্যানেল খোলা হচ্ছে।
ইংরেজিতে অনার্স থাকলেও, বাংলাতেও লাবণির যথেষ্ট দখল। দুটো ভাষাতেই চমৎকার। কলেজে পড়তে পড়তেই সে স্বপ্ন দেখত সাংবাদিক হবে। দেবনাথ তা জানতেন। মেয়েকে বোঝাতেন কয়েকটা চ্যানেল আর চার-পাঁচটা বিখ্যাত কাগজ ছাড়া বাকিগুলো টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। লাবণি ভালো করে ভেবে দেখুক, কী করবে।
মিডিয়ার দুরন্ত মোহ, তাছাড়া লাবণির আত্মবিশ্বাসটা প্রচণ্ড। সে নিশ্চিত ছিল, প্রিন্ট মিডিয়া বা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সুযোগ পাবেই। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, অর্থ সবই হবে। স্কুল মাস্টারির ভ্যাদভেদে, একঘেয়ে জীবন তার আদৌ পছন্দ নয়। সে সোজা মাস-কমিউনিকেশনে কোর্স করতে ভর্তি হয়ে গেল। শুধু সে-ই নয়, তার কলেজের অনেক বন্ধু একই স্বপ্ন দেখত। যেমন রাঘব, নন্দিনী, গোপা, রণেন, সুব্রত এবং আরও কয়েকজন। তারই সঙ্গে ওরাও ভর্তি হল। এদের মধ্যে লাবণির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হল রাঘব। ভারি সরল, অকপট, তার মধ্যে কোনওরকম নোংরামি নেই। মাথায় কোনও মতলব বা স্বার্থ নিয়ে সে কারও সঙ্গে মেশে না। বন্ধুদের কেউ, বিশেষ করে লাবণি ভালো কিছু করলে সেটা যেন তার নিজেরই সাফল্য।
হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর রাঘব আর সে আলাদা আলাদা স্কুল থেকে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। তখনই আলাপ-পরিচয়, কয়েদিনের মধ্যে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বটা দিনে দিনে আরও গাঢ় হয়েছে।
রাঘবদের বাড়ি টালিগঞ্জের চণ্ডীতলায়। সেখান থেকে বাঁশদ্রোণী আর কতদূর? অটোয় উঠলে মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে পৌঁছনো যায়। রাঘব ছুটির দিনে প্রায়ই লাবণিদের বাড়ি চলে আসত। তার স্বভাবে এমন একটা আপন করা ব্যাপার আছে যে দেবনাথও তাকে খুব পছন্দ করতেন। রাঘব এলে খুশি হতেন।
মাস-কমিউনিকেশন সেশন শেষ হলে চ্যানেলে চ্যানেলে আর খবরের কাগজের অফিসগুলোতে হানা দেওয়া শুরু হল। মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত হলেও চাকরি জোটানো সম্ভব হচ্ছিল না। একমাত্র রণেনই নর্থ বেঙ্গলের একটা ছোট চ্যানেলে চাকরি পেল। বাকি সবাই কাজের চেষ্টায় ঘুরছে। নানা কাগজে টুকটাক এটা সেটা লিখে কিছু পয়সা পাচ্ছে।
রাঘব এসে একদিন খবর দিল একটা নামকরা বাংলা কাগজে আর একটা সর্বভারতীয় ইংরেজি ডেইলিতে চাকরি নয়, তবে ওদের ফরমাশমতো লিখলে আর সেই লেখা ওদের পছন্দ হলে ছাপবে। অবশ্য তারা নিজেরাও যদি চমকপ্রদ বিষয় খুঁজে নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে দেয়, ছাপা হবে। এর জন্য বেশ ভালো অঙ্কের টাকাও পাওয়া যাবে।
রাঘব লাবণিকে সঙ্গে করে দুটি কাগজের দুই বার্তা-সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করল। তারা কয়েকটা বিষয় জানিয়ে দিয়ে লেখা তৈরি করে আনতে বললেন।
মনে আছে লেখাগুলো খুব খেটেখুটে, সময় নিয়ে যত্ন করে, লিখে জমা দিয়ে এসেছিল লাবণিরা। তারপর একটা সপ্তাহ ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছে। লেখা ভালো না লাগলে নিশ্চয়ই নিউজ এডিটররা ছাপাবেন না। দুই কাগজের দরজা তাদের কাছে বন্ধ হয়ে যাবে।
সাতদিন পর দেখা গেল বাংলা ইংরেজি দুটো কাগজেই তাদের লেখা বেরিয়েছে। টেনশন থেকে পুরোপুরি মুক্ত। লাবণিরা দুই কাগজের অফিসে ছুটল। দুই বার্তা-সম্পাদক তাদের লেখার স্টাইল, ভাষা, প্রকাশভঙ্গির তারিফ করলেন–গুড।