জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা, রুচি, কালচার, কোনও কিছুতেই সুশোভন আর মণিকার মধ্যে এতটুকু মিল নেই। তু তাদের বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল। প্রেমের বিয়ে নয়। দুপক্ষেরই এক আত্মীয় যোগাযোগটা ঘটিয়ে দিয়েছিল।
বিয়ের পর কলকাতায় এসে দু-চারদিন কাটাতে না কাটাতেই চমকে উঠেছিল মণিকা। সুশোভনের বন্ধুবান্ধব বা বড় বড় কোম্পানির একজিকিউটিভ এবং তাদের স্ত্রীরা প্রায়ই আসত। সতীশ হুইস্কি-টুইস্কি বার করে দিত। যে মহিলারা আসত তারাও পাড় মাতাল। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারা রাম কি হুইস্কি খেত।
এমন দৃশ্য আগে আর কখনও দেখেনি মণিকা। সে শিউরে উঠত। অন্য একটা ঘরে ঢুকে দম বন্ধ করে সিঁটিয়ে বসে থাকত। সুশো এসে ডাকাডাকি করত, কী। হল? ওঁরা তোমার জন্যে ওয়েট করছে— এস। মণিকা জানাতো, মদের আসরে সে যাবে না। কাকুতি-মিনতি করেও ফল কিছুই হত না। সুশোভন বলত, ‘ওঁরা কী ভাবছেন বল তো?’ মণিকা বলত, ‘যা খুশি ভাবুক। বাড়িতে ‘বার’ না বসালেই কি হয় না?’ সুশোভন কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলত, কী করব বল। দিস ইজ আ পার্ট অফ মাই জব। আমার কেরিয়ার, আমার ফিউচারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। প্লিজ এস, ফর মাই সেক।
প্রথম প্রথম কিছুতেই মদের আসরে যেত না মণিকা। পরে অনিচ্ছাসত্ত্বেও খানিকটা অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছিল। সুশোভনের বন্ধুবান্ধব এবং তাদের স্ত্রীরা এলে সে ওদের সামনে যেত ঠিকই, তবে হুইস্কির ছোঁয়া বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলত। অবশ্য সঙ্গ দেবার জন্য হাতে একটা সফট ড্রিঙ্কের গেলাস রাখত।
সুশোভনের বন্ধুরা বলত, একটু হুইস্কি টেস্ট করুন ম্যাডাম। পুরাকালে ঋষিটিষিরাও সোমরস পান করতেন। জিনিসটা খুব অস্পৃশ্য নয়।
মণিকা উত্তর দিত না।
বন্ধুরা আবার বলত, আফটার ডেথ যখন ওপারে যাবেন তখন ব্রহ্মা বিষ্ণুরা এক্সপ্লেনেশন চাইবে— মা জননী, ওয়ার্ল্ডে যে তোমাকে পাঠালাম, হুইস্কিটা টেস্ট করে এসেছ তো? তখন কী উত্তর দেবেন? মানব জীটা এভাবে নষ্ট হতে দেবেন না ম্যাডাম।
মণিকা আবারও চুপ।
বন্ধুদের স্ত্রীরা বলত, ‘তোমার মতো পিউরিটান মেয়ে লাইফে দেখিনি। ড্রিংক করলে ক্যারেক্টার নষ্ট হয় না।’
এসব কথারও উত্তর দেওয়া দরকার মনে করত না মণিকা। মনের দিক থেকে সায় না থাকলেও দাম্পত্য জীবনের খাতিরে দাঁতে দাঁত চেপে এসব মেনে নিতে হত তাকে। তবে কম বয়সের ছেলেমেয়েদের লেভেলে নেমে তাদের সঙ্গে সমান তালে সুশোভন যখন হুল্লোড় করত তখন অসহ্য লাগত।
ভেতরে ভেতরে বারুদ একটু একটু করে জমছিলই। কিন্তু বিস্ফোরণটা ঘটল দেড়-দুই বছর আগে। মণিকা যেদিন জানতে পারলে, কাজটাজ বাগাবার জন্য সুশোভন কাউকে ঘুষ দেয়, কাউকে কাউকে সঙ্গ দেবার জন্য সুন্দরী যুবতী যোগাড় করে তখন তার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। যা কখনও সে করে না, যা তার স্বভাবের বাইরে, ঠিক তাই করে বসেছিল। উত্তেজিত মুখে চিৎকার করে বলেছিল, তুমি ঘুষ দাও?
স্থির চোখে অনেকক্ষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থেকেছে সুশোভন। বলেছে, ‘ঘুষ না, গিফট।
‘একই বস্তু। আর ওই মেয়েদের ব্যাপারটা?’
‘নাথিং নাথিং’ টোকা দিয়ে গা থেকে পোকা ঝাড়ার মতো ভঙ্গি করে বলেছিল সুশোন।
দাঁতে দাঁত চেপে মণিকা বলেছিল, ‘নাথিং বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না।’
কাঁধ ঝাঁকিয়ে, দুই হাত উলটে সুশোভন হালকা গলায় বলেছিল, ‘এ নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। খুব সিম্পল ব্যাপার। কেউ কেউ মেয়েদের কোম্পানি পছন্দ করে। এই একটু গল্প-টল্প করতে চায়। জাস্ট আ টেণ্ডার ফেমিনিন টাচ।’
সোজাসুজি সুশোভনের চোখের দিকে তাকিয়ে মণিকা চাপা অথচ কঠিন গলায় বলেছে, ‘এ তোমাকে ছাড়তে হবে।‘
হাসির একটা পলকা ভঙ্গি করে সুশো বলেছে, কী যে বল, তার কোনও মানে হয় না।
‘নিশ্চয়ই হয়। আমি চাই না আমার স্বামী কেরিয়ারের জন্য এত নিচে নামুক।‘
‘নিচে নামানামির কী আছে! দিস ইজ আ পার্ট অফ আওয়ার লাইফ।‘
‘এ ধ্বনের লাইফের দরকার নেই আমার। তোমার সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা নষ্ট হতে দিও না।‘
মণিকার কণ্ঠস্বরে এমন এক দৃঢ়তা ছিল যাতে সুশোভন চমকে উঠেছে। বলেছে, ‘একটা তুচ্ছ বাজে ব্যাপার দেখছি তোমার মাথায় ফিক্সেশানের মতো আটকে গেছে। আজকাল র্যাট রেসে টিকে থাকতে হলে, জীবনে ওপরে উঠতে হলে, মানুষকে অনেক কিছু করতে হয়।‘
‘খুব বেশি রাইজ আর অনেক টাকার দরকার কী? ভদ্রভাবে চলে গেলেই হল।‘
সুশোভন বোঝাতে চেষ্টা করেছে, তার বন্ধুবান্ধবরা টাকা পয়সার জন্য, প্রোমোশনের জন্য কত কী করে বেড়াচ্ছে। তাদের স্ত্রীরা এই নিয়ে মণিকার মতো খিটিমিটির তো করেই না, বরং রীতিমত উৎসাহই দেয়।
মণিকা বলেছে, তোমার দুর্ভাগ্য, আমি তোমার বন্ধুর স্ত্রীদের মতো উপযুক্ত সহধর্মিণী হতে পারিনি।
মাথার ভেতরটা এবার গরম হয়ে উঠেছে সুশোভনের। বলেছে, ‘দেখ, মস্তিষ্কে নাইনটিনথ সেঞ্চুরির কিছু ভ্যালুজ ঢুকিয়ে বসে আছ। ও আজকাল একেবারে অচল, টোটালি মিনিংলেস। তোমার বাপু কোনও সাধু-টাধু টাইপের লোককে বিয়ে করা উচিত ছিল। আমি তোমার লাইফে মিসফিট।’
হিতাহিত জ্ঞানশূন্যের মতো মণিকা তৎক্ষণাৎ বলেছে, ‘বোধহয়। এই বিয়েটা তোমার আমার কারও পক্ষেই হয়তো ভাল হয়নি।’
এরপর আর কিছু বলার ছিল না সুশোভনের। স্তব্ধ বিস্ময়ে বিমূঢ়ের মতো সে তাকিয়ে ছিল।