বাড়িতে কাজের লোক তিনজন। জবা, মুকুন্দ আর মালতী। জবা দুবেলা রান্না করে। ঘর ধোয়ামোছা, বাসনমাজা, কাপড় কাঁচা, বাজার করা, এমন ভারী ভারী কাজের দায়িত্ব মুকুন্দর। মালতী আয়া, সে সামুকে দেখাশোনা করে। তিনজনই খুব বিশ্বাসী।
জবা চা দিয়ে গেল। আলতো চুমুক দিতে দিতে টেবিল থেকে একটা কাগজ তুলে নিয়ে হেডলাইনগুলো দেখতে লাগল লাবণি।
হঠাৎ মোবাইলে বেজে উঠল। ছুটির দিন বলে রেহাই নেই। গন্ডা গন্ডা ফোন আসে। বেশিরভাগই অফিসের কলিগদের। যেহেতু লাবণি নিউজ ডিপার্টমেন্টের উঁচু পোস্টে আছে, রাজনৈতিক দলের তো বটেই, বিনোদন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের লোকজনও তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
লাবণি মোবাইলের দিকে তাকাল। অচেনা একটা নাম্বার ফুটে উঠেছে। কে হতে পারে? ফোনটা তুলে নিয়ে হ্যালো বলতেই ভাঙা ভাঙা একটা গলা ভেসে এল–আমি কি লাবণি মজুমদারের সঙ্গে কথা বলছি? বয়স্ক কোনও মহিলার দুর্বল কণ্ঠস্বর।
আমিই লাবণি। আপনি কে বলছেন?
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর শোনা গেল, আমি সরোজিনী। চিনতে পারছ মা? বলার ভঙ্গিতে কুণ্ঠা, দ্বিধা, হয়তো একটু আকুলতাও মেশানো।
নামটা শোনার পরও কিছুই পরিষ্কার হল না। কে সরোজিনী? লাবণি বলল, না, মানে, আপনাকে ঠিক
আমি সরোজিনী মল্লিক। লেক টাউনের
এবার মাথার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে গেল লাবণির। অনেক আগেই মনে পড়া উচিত ছিল। কিন্তু যাদের জীবন থেকে চিরকালের মতো খারিজ করে দিয়েছে তাদের কেউ যে ফোন করতে পারে, ভাবা যায়নি। তা ছাড়া সরোজিনীর গলার স্বরটা আগের মতো নেই। মুখটা কঠিন হয়ে উঠল লাবণির। কঠিন গলায় বলল, হঠাৎ এতদিন পর আমাকে ফোন?
তুমি ছাড়া ফোন করার মতো আমার আর কেউ নেই লাবণি। কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলাম, ফোনটা করব, কিন্তু সাহস হচ্ছিল না।
লাবণির মাথায় লেক টাউনের সেই বাড়িটার লোকজন সম্বন্ধে একসময় প্রবল ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা এবং ক্রোধ জমা হয়ে ছিল। ধীরে ধীরে তার ঝাঁঝ কমেও এসেছিল। লেক টাউনের সেই মানুষগুলোর চেহারা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু হঠাৎ সরোজিনীর ফোনটা আসার পর পুরোনো ক্ষোভ, রাগ স্মৃতির অতল স্তর ভেদ করে বেরিয়ে এসে যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। গলার স্বর উঁচুতে তুলে লাবণি বলল, অনেকদিন আগেই তো আপনাদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকেবুকে গেছে। তা হলে আবার ফোন কেন? নতুন করে যোগাযোগ করার কী প্রয়োজন?
জানি, তুমি আমাদের বাড়িতে এসে শান্তিতে থাকতে পারোনি। চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছ। তোমার ক্ষোভ, রাগ, এসব থাকা খুবই স্বাভাবিক। তবু একটা বিশেষ দরকারে ফোন করতে হল।
অরিজিৎ মল্লিক লাবণির প্রাক্তন স্বামী। লেক টাউনের বাড়িতে সে তাকে কম নির্যাতন করেনি। এই সরোজিনী মল্লিকও ছেলের সঙ্গে সমান তাল মিলিয়ে যেতেন। কিন্তু লাবণি অসভ্য, ইতর নয়। উম্মা যেটুকু প্রকাশ করার করেছে। নিজেকে এবার কিছুটা সামলে নিয়ে জিগ্যেস করল, আপনি আমার ফোন নম্বর পেলেন কীভাবে?
সরোজিনী বললেন, তোমাদের চ্যানেলে একজনকে দিয়ে ফোন করে জেনে নিয়েছি।
ও। তা দরকারের কথা যে বলছিলেন, সেটা কী?
তোমার সঙ্গে দেখা হলে বলব।
কী চান আপনি? ফের তিক্ত হয়ে উঠল লাবণিআমি লেক টাউনে গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব? একটা কথা স্পষ্ট শুনে রাখুন, যে বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে এসেছি সেখানে এ জন্মে আর কখনও যাব না।
না, না– সরোজিনী উতলা হয়ে উঠলেন। লেক টাউনে আমি আর থাকি না।
রীতিমতো অবাকই হল লাবণি। তা হলে কোথায় থাকেন?
বছরখানেক হল বোড়ালের কাছে একটা বৃদ্ধাশ্রমে।
লাবণি চমকে উঠল-বৃদ্ধাশ্রম! মানে ওল্ড এজ হোম?
সরোজিনী মোটামুটি শিক্ষিতা। সেই আমলের ম্যাট্রিকুলেট। বললেন, হ্যাঁ।
লেক টাউন থেকে ওল্ড এজ হোম! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
তুমি ভীষণ ব্যস্ত মানুষ। বলতে সাহস হয় না, তবু বলছি। পরশুর মধ্যে তুমি কি দয়া করে একবার হোমে আসতে পারবে? এলে সামনাসামনি বসে সব বলব। হোম থেকে আমাকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে, পরশু পর্যন্ত ওখানে থাকতে পারব। তারপর এলে আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। বলে, একটু থেমে সরোজিনী ফের শুরু করলেন, তুমি যদি না আসো, একটা মারাত্মক অপরাধবোধ নিয়ে বাকি জীবনটা আমাকে রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়ে দিতে হবে। তার শেষ কথাগুলো কাতর মিনতির মতো শোনাল।
যাবে কি যাবে না, ঠিক রতে পারছে না লাবণি। একদিন এই মহিলার কী না ছিল। লেক টাউনে তার স্বামীর মস্ত তেতলা বাড়ি, ব্যাঙ্কে লক্ষ লক্ষ টাকা, ছেলে অরিজিৎ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু পোস্টে। সেই তিনিই নাকি শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে? তার সঙ্গে সরোজিনী যত দুর্ব্যবহারই করে থাকুন, এখন যেন একটু করুণাই হচ্ছে। সেই সঙ্গে কৌতূহলও। লাবণি মনস্থির করে ফেলে।–আচ্ছা যাব।
কবে মা?
আজই। আমাদের বাঁশদ্রোণীর বাড়ি থেকে বোড়াল খুব দুরে নয়। ঠিকানাটা দিন। ঘণ্টাখানেক ঘণ্টাদেড়েকের ভেতর পৌঁছে যাব।
সরোজিনী শুধু ঠিকানাই নয়, কীভাবে সেখানে যেতে হবে, সব বুঝিয়ে দিলেন।
ফোন অফ করে লাবণি জবাকে তাড়া দিল। জবাদি, আমাকে তাড়াতাড়ি দুটো টোস্ট আর ডিমের অমলেট করে দাও। সেই সঙ্গে আরেক কাপ চা। আমাকে এক্ষুনি বেরুতে হবে।
জবা কিচেনে খুটখাট, ঠুং ঠাং করে রান্নার তোড়জোড় করছিল। বলল, দিচ্ছি।