না।–হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে নিরাসক্ত গলায় জবাব দিল মাঝি রসুল।
অন্ধকার একটু একটু করে ঘন হল। আকাশে একখানা গোল চাঁদ আর তারা দেখা দিল। জলো দুধের মতো ফিকে জ্যোৎস্না আকাশ-নদী মুড়ে রেখেছে।
কাছে দূরে, আরও দূরে ইলশা-ডিঙি ঘুরে বেড়ায়। এখন ইলিশের মরশুম। রাশি রাশি জোনাকির মতো ইলশা-ডিঙির আলোগুলো নদীময় ছুটাছুটি করে।
মনটা কেমন জানি উদাস উদাস লাগে রসুল মাঝির। পালের বাতাসের শব্দ, ঢেউয়ের একটানা শব্দ, মেঘনার রাশি রাশি ইলশা-ডিঙি আর ছইয়ের মধ্যে আজিমা-না না, মিঞা সাহেবের বিবিজান–সব মিলিয়ে এক দুর্বোধ্য অথচ ভয়ানক যন্ত্রণা সমস্ত মনকে অসাড় করে রাখে। জীবন তত তার বরবাদই হয়ে গিয়েছে। রসুল মাঝি ভাবল, নৌকা ডুবিয়ে আজিমার সাধের আর সুখের জীবনটাকে সে দুনিয়া থেকে মুছে দেবে। আবার ভাবল, পাটাতনের নীচে বড় একটা কোঁচ রয়েছে। সেটা দিয়ে মিঞা সাহেবকে কুপিয়ে মেঘনার খরধারায় ভাসিয়ে আজিমাকে নিয়ে সন্দীপ কি হাতিয়ায় পাড়ি জমাবে। অজানা অচিন জায়গায় নতুন করে জীবন শুরু করবে। ভাবল, কিন্তু হালের বৈঠাটা শক্ত মুঠোয় চেপে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করল না রসুল মাঝি। পারল না।
মাঝখানে জেলেদের কাছ থেকে গোটা দুই ইলিশ মাছ কিনে নিল মিঞা সাহেব।
রাত্রি আরও ঘন হল। চাঁদের আবছা আলো ঢেউয়ের মাথায় মাথায় দোল খায়। ইলশা-ডিঙির আলোগুলো জ্বলে নেবে, নেবে জ্বলে।
লখাইর চর, ভাতারখাকির চর, নাককাটির চর পেরিয়ে চরসোহাগীর চরে নৌকা ভিড়াল রসুল মাঝি। এখন মাথার উপর চাঁদটা উঠে এসেছে।
মিঞা সাহেব আর বিবিজান চরের মাটিতে নামল।
মিঞা সাহেব বলে, চুলা আছে মাঝি?
নিঃশব্দে পাটাতনের তলা থেকে উনুন বের করে দিল রসুল। কাঠকুটো জ্বালিয়ে ভাত চাপিয়ে দিল বিবিজান। পাশে বসে রান্নাবান্নার যোগান দিতে দিতে অবিরাম বকর বকর করে মিঞা সাহেব। আর নৌকার গলুইতে আচ্ছন্নের মতো বসে থাকে রসুল মাঝি। দুর্বোধ্য ভীষণ যন্ত্রণাটা হাড়ে মজ্জায় শিরায় শিরায় পাক দিতে থাকে।
উনুনের গনগনে আগুনে বিবিজানের শ্যামলা মুখখানা লাল দেখায়। নাকের বেশরটা ঝিকমিক করে। এক গোছা এলোমলো চুল সারা গালে মাখামাখি হয়ে রয়েছে। দেখতে দেখতে ইন্দ্রিয়গুলি বিকল হয়ে যায়।
কত কি ভাবে রসুল মাঝি! ফেচুপুর গ্রামের কথা, নিকারীদের মেয়ে আজিমার কথা, বড় ব্যাপারী আর রোশেনাবানুর কথা, আরাকানের বড় চালানটার কথা, আসমান-জমিন একাকার করে নানা কথা ভাবে। সে ভাবনার তল-কুল-বাঁও মেলে না।
অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল রসুল মাঝি। এক দৃষ্টে বিবিজানের দিকে তাকিয়ে রইল। আরও খানিকটা পর মিঞা সাহেব ডাকতে এলঃ মাঝি খাইবা আস।
মিঞা সাহেবের পিছু পিছু সম্মোহিতের মতো উঠে এল রসুল মাঝি। দেহ-মনের উপর নিজের কোনও মজিই ক্রিয়া করছে না। এখন এমন অবস্থা, কেউ তাকে চালনা করলেই তবে সে চলতে পারে।
খেতে বসে ককিয়ে উঠল রসুল মাঝি? আমি যে ইলিশ মাছ খাই না।
হালকা গলায় মিঞা সাহেব বলল, খাও, খাও মাঝি। পয়লা বর্ষার মাছ। জবর স্বোয়াদ। জবর তেল।
কোনও কথা না বলে উঠে দাঁড়াল রসুল মাঝি। আর সহসাই ঘটে গেল ঘটনাটা। কেউ কিছু করবার বা বলবার আগেই। দুটি নধর নরম হাত দিয়ে রসুল মাঝির একটা হাত চেপে ধরল আজিমা। গাঢ়, থামা-থামা, ভেজা গলায় বলল, খাও মাঝি, আমি রান্না করছি। আমি কইতে আছি।
নিরালা নির্জনচর। হু-হুঁ বাতাস। মেঘনার একটানা ঢেউয়ের শব্দ। ফিকে ফিকে আবছা জোছনা। ভাত খেতে খেতে রসুল মাঝির মনে হল, তার চোখ থেকে জল ঝরে ঝরে ইলিশের স্বাদকে বড় নোনা করে তুলেছে।
দুচার গরাস ভাত খেয়ে মুখ তুলল রসুল মাঝি। চোখাচোখি হল। এক রাশ চুল, নাকে সোনার বেশর, কানে বনফুল, শ্যামলা রঙের একটি ঢলঢলে মুখ। দুটি ঘনপক্ষ্ম কালো চোখ তার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রয়েছে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে রসুলের মনে হল, সে চোখ দুটিতে জল চিকচিক করছে।
লাবণির জীবনযাপন
লাবণি মজুমদার একটা নামকরা বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল সাতরং-এর ডেপুটি নিউজ এডিটর। সপ্তাহের ছটা দিন তার প্রচণ্ড কাজের চাপ থাকে। বুধবার শুধু ছুটি। চাপমুক্ত হয়ে এই দিনটা সে নিজের মতো করে হালকা মেজাজে কাটিয়ে দেয়।
আজ বুধবার। অন্য দিন সকালে সাতটা সাড়ে সাতটায় সে উঠে পড়ে। সাড়ে দশটায় তার আফিসের গাড়ি চলে আসে। তার মধ্যে স্নান-টান করে, ব্রেকফাস্ট সেরে তৈরি হয়ে নেব লাবণি।
আজ কোনওরকম তাড়াহুড়ো নেই। লাবণির ঘুম ভাঙল নটায়। তারপর সোজা বাথরুমে। মিনিট পনেরো বাদে, বেরিয়ে এসে বাসি নাইটি পালটে একটি ঢোলা হাউসকোট টাইপের গায়ে চাপিয়ে, হাতে মোবাইল নিয়ে দোতলার প্রশস্ত বারান্দায় একটি গদি-আঁটা চেয়ারে আয়েশ করে বসল লাবণি। পাশেই ছোট, নিচু একটা টেবিল। সেটার ওপর আজকের মর্নিং এডিশনের পাঁচটা খবরের কাগজ গুছিয়ে রাখা আছে। হাতের মোবাইলটা সেগুলোর পাশে রাখল সে।
এই দোতলা বাড়িটা তার বাবা দেবনাথ মজুমদার কুড়ি-বাইশ বছর আগে তৈরি করেছিলেন। বছর বারো আগে, মা মারা গেছেন। তিন বছর হল, বাবারও মৃত্যু হয়েছে। বাড়িটা এখন শুধু সে আর একমাত্র বিকলাঙ্গ ছোটভাই কমল, যার ডাকনাম সোমু। জন্মের পর থেকেই সে শয্যাশায়ী। লাবণির বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ। কিন্তু এখনও যথেষ্ট সুন্দরী।