গঞ্জের মহাজনের কাছে প্রচুর ধার। আরাকানের এত বড় চালানটা নষ্ট হল। দিনরাত গুম মেরে বসে থাকে রসুল। কাজকর্মে ফুর্তি নেই। মাসখানেকের মধ্যে চোখ কোটরে ঢুকল, হনু দুটো ফুঁড়ে বেরুল। মুখের টান টান সতেজ চামড়ায় ভাঁজ পড়ল।
প্রথম প্রথম দু-চারদিন বড় ব্যাপারী আসত। বলত, রসুল মিঞা, এইবার সাদিটা চুকাইয়্যা ফেলুন। বেফয়দা দেরি কইর্যা লাভ নাই।
রসুল জবাব দিত না, শুধু মাথা নাড়ত। তাতে হানা বোঝার উপায় থাকত না। উদাস চোখে সামনের মজা খাল আর বাজপোড়া ন্যাড়া তালগাছটার মাথায় একটা চিলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত।
খোঁজখবর নিয়ে রসুলের হাল হকিকত জেনে গেল বড় ব্যাপারী। বাজারে প্রচুর দেনা। আরাকানের চালান বরবাদ। বড় ব্যাপারীর আসা বন্ধ হল।
গ্রামের এক প্রান্তে নিরালা নির্জন পঁচিশ বন্দের ঘরখানায় আরও দিনকতক কাটিয়ে এক নিবুনিবু রোদের বিকেলে নিকারীপাড়ার দিকে পা বাড়িয়ে দিল রসুল। আজিমাকে তালাক দেওয়ার পর এই বাড়ি কি নিরানন্দ, কি শ্রীহীন হয়ে গিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনতেই হবে। যেমন করেই হোক। আজিমার মুল্যে সে রোশেনাবানুকে চেয়েছিল। কিন্তু কিসমাতের মর্জি বোধ হয় অন্যরকম। রসুলের মনে হল, নিকারীদের মেয়ের মেহেরবানি না পেলে আরাকানের বিরাট চালানটার মতো তার জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে।
নিকারীপাড়ায় যাবার পথে বিশাল রবিশস্যের মাঠ। আলপথে কাসিমালি নিকারীর সঙ্গে দেখা হল। কাসিমালি আজিমার চাচাজান।
ভাঙা ভীরু গলায় রসুল বলল, চাচা, আজিমারে তালাক দিয়া গুনাহ করছি। কসুর মাপ করেন। আজিমারে আবার দেন আমারে। ওরে না পাইলে, এই জনম নষ্ট হইয়া যাইব আমার।
কাসিমালি নিকারীর গলায় বিদ্রূপ ফুটল, মস্করা করেন না কি রসুল মিঞা! বড় ব্যাপারীর মাইয়া রোশেনাবানুর লগে আপনের নিকাহ হইব। সারা গেরামের মানুষ সেই খবর জানে। গরিব মানুষেরে নিয়া খেলা করনের মর্জি এখনও যায় নাই!
না না, চাচা। কোনও মন্দ মতলব নাই আমার আর্তনাদ করে উঠল রসুল। নিবুনিবু রোদের বিকেলটা চমকে উঠল।
রসুলের মুখ চোখ দেখে আর আর্তনাদ শুনে কিছু একটা আন্দাজ করল কাসিমালি নিকারী। সহজ স্বাভাবিক, একটু বা সহানুভূতির সুরেই বলল, কিন্তু কই রসুল মিঞা, দিন তিনেক হইল আজিমার যে আবার নিকাহ হইছে। ফরিদপুরে সোয়ামীর ঘর করতে গেছে আজিমা।–ক্ষিপ্র অস্বাভাবিক দ্রুত পা ফেলে কাসিমালি চলে গেল।
কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মতো দাঁড়িয়ে রইল রসুল। এই দেহে প্রাণ আর যেন বাজছে না। মন চেতনা ভাবনা সব অথর্ব হয়ে গিয়েছে। সারা দেহের হাড় মাংস রক্ত তালগোল পাকিয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। একটু পরে এই ভাবটা কেটে গেলে রসুলের মনে হল, অসহ্য ভয়ানক এক যন্ত্রণা দেহটাকে মনটাকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে দুমড়ে মুচড়ে চুরমার করে দিচ্ছে। এলোমেলো পায়ে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে এল রসুল।
পরের দিনই বাড়ি বেচে মহাজনের দেনা শোধ করে ফেচুপুর ছেড়ে চলে গিয়েছিল রসুল। সেই থেকে আর ইলশা-জাল বায় না, নোনা ইলিশের চালান নিয়ে নোয়াখালি কি কক্সবাজারের দিকে পাড়ি জমায় না। নিকারীদের মেয়ে আজিমার সঙ্গে সঙ্গে নোনা ইলিশের ব্যবসার পালা চুকে গিয়েছে। ঘুচে গিয়েছে। ইলিশ মাছের উপর কেমন একটা বিতৃষ্ণা ধরে গিয়েছিল রসুলের। ইলিশ মাছ সে খায় না, ছোঁয় না। দেনা শোধ করে এক-মাল্লাই নৌকা কিনেছিল। সেটা নিয়ে গঞ্জে বন্দরে, চর-চরান্তরে কেরায়া বায়। সওয়ারি পারাপার করে। পদ্মা-মেঘনা ইলশা কালাবদরের ঢেউ কেটে কেটে তার একমাল্লাই ছুটে চলে।
.
তাজ্জবের ব্যাপার। এত বছর পর, বলা যায়, নতুন এক জন্মান্তরে সেই আজিমা যে মিঞা সাহেবের বিবিজান হয়ে তার নৌকার সওয়ারি হবে, এ কথা কি কোনওদিন আন্দাজ করতে পেরেছিল রসুল মাঝি! আজিমার নিকাহর কথা শোনার পর যেমনটি হয়েছিল, ঠিক তেমনি এক দুঃসহ যন্ত্রণা বুকের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে শ্বাসনালীর কাছে ফুলে ফুলে উঠছে।
নিবু নিবু রোদ মুছে গেল। আকাশ নদী জল ঢেউ–সব এখন আবছা, সব অস্পষ্ট। শুধু হাহাশ্বাসের মতো পালে একটানা বাতাস বাজছে।
আজিমা, না-রসুল মাঝি দেখল, মিঞা সাহেবের বিবিজান এখন তেরছা হয়ে ঘুরে বসেছে। শ্যামলা রঙের টলটল মুখ, একরাশ চুল, নাকের বেশর দেখা যাচ্ছে না।
উৎসুক গলায় রসুল মাঝি বলল, মিঞা সাহেবের ঘর কোথায়? কী কাজকাম করেন?
মিঞা সাহেব কিছু বলার আগেই বিবিজান শাণিত কষ্ট গলায় চেঁচিয়ে উঠল, মাঝির আবার অত খবরের দরকার কী?
বড় একটা নিশ্বাস ফেলে রসুল মাঝি বলল, দরকার আর কী বিবিজান? দরকার না থাকলেই কি জানাটা দোষ?
ছটফট করতে করতে ছইয়ের মুখে এল মিঞা সাহেব। তুমি কিছু মনে করো না মাঝি। বউটা আমার ছেলেমানুষ, মাথার ঠিক নাই।–একটু ছেদ, আবার : ফরিদপুরে আমার দেফসলা জমি আছে দুই শো কানি, সুপারি আর পাটের ব্যাপার আছে। খোদার ফজলে দিনকাল ভালোই চলে।
ভালো, ভালো।-ঘন ঘন মাথা নেড়ে রসুল মাঝি বলল, বিবিজান যে আপনের কাছে সুখে আছে, তাই জাইন্যা সুখ। ভালো, ভালো। জবর খোশ খবর।
ঘন রোমশ ভুরু দুটো একটু কুঁচকে গেল। তার পরেই হো হো শব্দে হেসে উঠল মিঞা সাহেব? আমি সুখ দেওনের কে? সবই খোদার মার্জি।
একটুক্ষণ চুপচাপ।
মিঞা সাহেব আবার বলল, গোঁসা হইলা না তো মাঝি?