দিন কতক পর কমলাঘাটের বন্দর থেকে রূপার মল আর পৈছা নিয়ে এল রসুল, বলল, এগুলি পর দেখি সোহাগ-বউ। তোরে জবর মানাইব।
দেখি, দেখি–নিমেষে কোমারে পৈছা, পায়ে মল পরে ফেলল আজিমা। নাকে বেশর, কানে বনফুল, হাতের পাতায় মেহেদী, দুটি ঘনপক্ষ্ম চোখ, আজিমাকে বুকের কাছে টেনে গাঢ় গলায় রসুল বলল, তুই কি সোন্দর বউ? আসমান-দুনিয়ায় তোর মতো খুবসুরৎ মাইয়া আর আমি দেখি নাই।
মিছা, মিছা। তুমি আমার মন রাখা কথা কও।
না, না। খোদার কসম। এই তোর গা ছুঁইয়া কই।–একটু থেমে রসুল বেজার গলায় বলল, আমি তোরে এত পিরীত করি, মব্বৎ করি আর তুই আমারে ইটুও পিরীত করিস না। বরাতটাই আমার মন্দ। সাদি করা বউর কাছ থিকা মহব্বৎ মিলে না।
আমি তোমারে পিরীত করি না!–ঝটকা মেরে দূরে সরে যায় আজিমা। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে। রোষে, ক্ষোভে শ্যামলা রঙের মুখখানা লাল দেখায়। চোখের কোণে নোনা জল টলটল করেঃ কেমনে বুঝলা আমি তোমারে পিরীত করি না?
বুঝি বুঝি! আমি সবই বুঝি। এক বছর সাদি হইছে, তবু বিশ্বাস কইর্যা একটা কথা আমারে কইতে পারলি না! ভার-ভার মুখ করে রসুল বলে।
কী কথা!
নোনা ইলিশের লগে কী মিশাইল?
একটুক্ষণ চুপ। তারপর আজিমা বলল, সে কথা কইতে বাপজান বারণ কইরা দিছে। আমি গরিব নিকারীর মাইয়্যা। জানো তো, নোনা ইলিশের ব্যবসার গুণ আছে আমাগো হাতে। আর ওই গুণেই আমাগো সাদি হয়। এই গুণ সকলে জাইন্যা ফেললে নিকারী মাইয়্যার আর সাদি হইব না। এমুন বিশ্বাসঘাতী কাম আমি করুম না।
আমি তোর সোয়ামী। আমারে কইলে কেউ জানব না। কারুরে জানামু না। না যদি কইস, তা হইলে একদিকে যামু গিয়া। ঠিকই যামু, খোদার কসম। বাপজানের বারণ আর এই বাড়িঘর লইয়্যা তুই থাকিস মনের সুখে।নির্বিকার ভঙ্গিতে খোদার নামে কসম খেয়ে বসে রসুল, মুখে চোখে একরোখা ভাব ফুটে বেরোয়।
ছুটে এসে রসুলের বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আজিমা : না না, তুমি যাইও না। কমু, নিচ্চয় কমু। শোনো, নোনা ইলিশের লগে কচুরিফুলের রস, আদা আর পেঁয়াজের রস, বিটলবণ মিশাইলে পচন-গলন লাগে না। কইলাম, তোমার উপুর বিশ্বাস রাখলাম। বিশ্বাস রাখা এইবার তোমার ধর্ম।
মাসখানেকের মধ্যে পাঁচশোমণী নৌকা ভরে নোনা ইলিশের চালান নিয়ে আকিয়াব রওনা হল রসুল। দুমাস পরে আকিয়াব থেকে ফিরে সে একেবারে আলাদা মানুষ। ঘরে বসে মদ খায়। চোখ টকটকে লাল। মাথা টলমল করে। পরনে রেশমি লুঙ্গি, ডোরাকাটা পিরহান, কানে আতর, গলায় সিল্কের রুমাল, সরু শিস দিয়ে দিয়ে মৃধাপাড়া, মাঝিপাড়া, ব্যাপারীপাড়ায় শৌখিন খুশির মূর্তি সেজে আবার ঘুরে বেড়াতে লাগল রসুল। নতুন করে দাওয়াত আর মেজবানের পালা শুরু হল। ব্যাপারীদের মেয়ে রোশেনাবানুর উপর নজর পড়েছে রসুলের।
সব–সব খবর কানে আসে আজিমার। নোনা ইলিশের কারবারে লোকজন খাটে। তারাই ঠিক ঠিক খবর যোগায়। প্রথম প্রথম কয়েকদিন আজিমা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদল।
রসুল ধমকে ওঠে, চুপ কর মাগি। মড়াকান্না কান্দে, কোন নাগর মরছে তোর? চুপ না মারলে গলা টিপে ধরুন।
রসুলের হাল হকিকত দেখে আর দিল-জ্বালানো বোলচাল শুনে কয়েকটা দিন স্তব্ধ হয়ে রইল নিকারীদের মেয়ে আজিমা। তারপর নিজের হক অধিকারের কথাটা স্মরণ করে কঠিন গলায় বলল, বড় যে কুচরিত্তির ইইছ! মদ খাও, ঘরে বউ থাকতে ব্যাপারীপাড়ায় যাও রোশেনাবানুর কাছে! সব খবরই আমার কানে আসে। কিন্তুক মতলবখান কী তোমার?
লাল চোখ তুলে টেনে টেনে হাসে রসুল : সব খবরই তোর কানে আসে। তুই জানিস তোর থিকা রোশেনাবাবু অনেক খুবসুরৎ?
কী কইতে চাও তুমি?–চমকে তাকাল আজিমা।
শোন তা হইলে। সিধা কথাটা সিধা কইর্যাই কই। রোশেনাবানুরে আমি নিকাহ করুম।
রোশেনাবানুরে নিকাহ করবা! ফিসফিস গলায় বলল আজিমা। বুকটা ধুক ধুক করল। সমস্ত হৃৎপিণ্ডটা মোচড় দিয়ে উঠল। অসহ্য যন্ত্রণায় দেহ মন ইন্দ্রিয় শিরা স্নায়ুগুলো যেন ছিঁড়ে ছিঁড়ে পড়ছে। রক্ত মেদ হাড়ের বস্তুময় দেহে যেন প্রাণের চিহ্ন নেই আজিমার।
হ।
তা হইলে বাপজানের কাছে আমারে পাঠাইয়া দাও।
একেবারে জন্মের মতোই পাঠাইয়া দিমু। শোন, তোরে তালাক দিমু।
দিন কয়েক পর মুছল্লির যোগসাজসে আর আইনের কারসাজিতে বাইন তালাক দিয়ে দিল রসুল। কালো বোরখায় সারা গা ঢেকে বাপজানের সঙ্গে নিকারীপাড়ায় চলে গেল আজিমা।
মাঝখানে একটা দিন। তারপরেই রোশেনাবানুর বাপ বড় ব্যাপারী এসে বলল, এইবার তা হলে দিন দেখি রসুল মিয়া!
দ্যাখেন! মাস তিনেকের মধ্যে একটা চালান নিয়া আরাকান যামু, সেখান থিকা ফিরা রোজা পাইল্যা নিকাহ করুম-খুসবু তামাকের ডিবে এগিয়ে দিতে দিতে রসুল বলল।
.
আরাকানের বিরাট চালানটা একেবারে বরবাদ হয়ে গেল রসুলের। জোয়ার ভাটা আর উজানি বাতাসের মর্জি এবং মেজাজ খোশ থাকলে আরাকান পৌঁছতে মাস দেড়েক লাগে। কিন্তু পৌঁছবার আগেই মাছে পচন ধরল। সমস্ত বর্ষার যত ইলিশ সে ধরেছে, তা বাদে কর্জ করে আরও অজস্র কিনেছে। সে সব ইলিশ কেটে মেটে হাঁড়ি ভর্তি করে পাঁচশোমনি নৌকো নিয়ে আরাকানের পথে পাড়ি জমিয়েছে রসুল।
আজিমার কাছ থেকে নোনা ইলিশের পচন রোধ করার মন্ত্রগুপ্তি জেনে নিয়েছিল। কিন্তু কতটা পরিমাণ বিটলবণ, কচুরিফুলের রস, আদার রস মেশাতে হবে, সে হিসাবটা শিখে রাখা হয়নি। মনে মনে আপসোসের অন্ত রইল না রসুলের। হাঁড়ি-বোঝাই পচা ইলিশ গাঙের জলে ফেলে ফেচুপুরে ফিরে আসতে হল।