খাওয়া-দাওয়ার পর বাটার সুগন্ধি মসলা এগিয়ে দিতে দিতে মৃধারা বলে, ব্যাপারীরা বলে, মাঝিরা বলে, সবাই বলে ও রসুল মিঞা, এইবার একটা সাদি করেন। সাদির সময় কিন্তুক আপনের হইছে।
রসুল জবাব দেয় না। মিটিমিটি হাসে। ব্যাপারীরা, মৃধারা, মাঝিরা ভাবে, শহরে-বন্দরে ঘুরে ঘুরে রসুল মিয়ার হালচাল, আদবকায়দাই বদলে গিয়েছে।
আবার শোনা যায়ঃ যদি মত করেন, তা হইলে আমার ছোট মাইয়াটা আছে। নাম রোশেনা। হে-হে, বুঝলেন কি না।
এবারও কোনও কথা বলে না রসুল। তবু সেই মিটিমিটি হাসিটাকে রহস্যময় করে তোলে। তারপর সুগন্ধি মসলা চিবুতে চিবুতে রাস্তায় গিয়ে নামে।
তিন বছর ধরে ফেচুপুর গ্রামে আছে রসুল। এর আগের চব্বিশ বছরের জীবনের ইতিহাস কেউ জানে না। সে সম্বন্ধে কেউ ভাবেও না। রসুল মিঞা, তার নোনা-ইলিশের ফলাও কারবার, শৌখিন রুচি আর হাল হকিকত ছাড়া আর কিছু তারা জানতেও চায় না।
তিনটে বছর এ-বাড়ি সে-বাড়ি মেজবান খেয়ে আর দাওয়াত দিয়ে দিয়েই কাটিয়ে দিল রসুল। ফেচুপুর গ্রামের জীবনে এই দাওয়াত আর মেজবানের পালা একটা অভ্যস্ত রীতির মতোই দাঁড়িয়ে গেল। এ ব্যাপারে আর চমক রইল না।
কিন্তু চমকের সবটাই বাকি ছিল। রাতারাতি নিকারীপাড়ায় মোল্লা-মুচ্ছল্লি ডাকিয়ে যেবার আজিমাকে সাদি করে আনল রসুল, সেবার সমস্ত ফেচুপুর গ্রামটা বেয়াড়া ধরনের এক বিস্ময়ে ঘায়েল হয়ে পড়েছিল। নিকারীদের ঘরে পচা চাচের দেওয়াল, ফুটি-ফাটা খাপরার চালে রোদবৃষ্টি বাগ মানে না। নিকারীদের ঘরে মাটির সানকি আর পিতলের গোটা দুই গ্লাস ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। সেই বাড়ির মেয়েকে সাদি করার মতো এত বড় একটা আহামুকি যে রসুল মিঞার মতো একটা শৌখিন খুশির মুর্তি করে বসতে পারে, তা কেউ ভাবতেই পারেনি। সারা ফেচুপুর, গ্রামটা কুৎসায় নিন্দায় সরগরম হয়ে উঠল। মৃধারা, ব্যাপারীরা, মাঝিরা একযোগে কাদা ছিটোতে লাগল। রসুল মিঞার মতো শয়তান, ইবলিশ আর কুচরিত্র মানুষ এত বড় আসমানের নীচে, এতবড় দুনিয়াটায় না কি আর একটিও নেই।
কিন্তু যাকে নিয়ে এত কুৎসা রটানো, এত নিন্দা ছড়ানো, সে একেবারেই নির্বিকার। কোনদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই।
সাদি করে নদীর কিনার ঘেঁষে ঘর তুলল রসুল। উপরে ঢেউটিনের চাল, দুপাশে ময়ুরমুখ আঁকা, ফরিদপুরের কারিগর কাঠের দেওয়ালে বাটালি দিয়ে কেটে কেটে ফুলপাতা বার করল।
ব্যবসা আরও বড় হয়েছে রসুলের। চাটগাঁ, কক্সবাজার কি নোয়াখালির গঞ্জ-বন্দর ছাড়িয়ে আকিয়াব-আরাকানে ছড়িয়ে পড়েছে।
নাকে বেশর, কানে বনফুল, চোখে সুর্মা, হাতে মেহেদী, একরাশ চুল আর শ্যামলা রঙের ঢলল মুখ আজিমা ছুটে বেড়ায়। ইলিশ মাছ কাটে, নতুন মেটে হাঁড়িতে নুন দিয়ে সেই মাছ জারায়। হাঁড়ির মুখে সরা দিয়ে গুনতি করে। কিছুদিন মক্তবে পড়েছিল, তার দৌলতে কাগজে-কলমে হিসাব রাখে আজিমা। লোকজন খাটে। ঠিক ঠিক হিসাব করে তাদের মজুরি দেয়।
রসুল বলে, বুঝলি সোহাগ-বউ, তোর বরাতে আমার বরাত খুলল। এই ব্যবসা যে এত বড় হইছে, সব তোর জন্যে। তোরে যেদিন সাদি করছি, সেদিন থিকাই আমার কপাল খুলছে। আগে-আগে আমার মাছ নোয়াখালি-চাটগাঁর গঞ্জে যাইত। আইজকাল আকিয়াব, আরাকান, এমুন কী রেঙ্গুনেও চাহিদা হইছে।একটু ছেদ, আবার তোর হাতে জাদু আছে সোহাগ-বউ। আর সকলের মাছ পাঁচ-ছমাসেই পচে গলে, কিন্তু আমার মাছ এক বছরেও যেমুনকে তেমুনই থাকে। লবণের লগে মাছে আর কি দিস রে বউ?
আজিমা হাসে, বলে, তোমার মাছে আমার মনের ঝাঁঝ মিশাই। সেই ঝাঁঝে মাছ পচন-গলন লাগে না। বুঝলা মিঞা। আর কথা না। এইবার খাইবা আসো।
আগে বল, কী মিশাইয়া দিস? না কইলে খামু না।
কপট রোষে ফুঁসে ওঠে আজিমা এই দিকদারি আর ভালো লাগে না মিঞা। আগে খাইবা চলো।
তুই তা হলে বলবি না বউ?–কঠিন গলায় রসুল বলে।
হালকা তামাসায় সব-কিছু উড়িয়ে দিতে চায় আজিমা : কী আবার কমু! হাতের গুণ মিঞা, হাতের গুণ। এমুন হাতের গুণ যে পচন-গলন তো দূরের কথা, কাটা মাছ জোড়া দিয়া জলে ছাড়লে তাজা হইব।
বেশ, না বললি।–গুম মেরে বসে থাকে রসুল।
রাত্রে আজিমার পাশে শুয়ে শুয়ে রসুল ভাবে, মৃধাপাড়া, ব্যাপারীপাড়া, মাঝিপাড়ার তিন বছরের দাওয়াতকে অগ্রাহ্য করে নিকারীদের মেয়ে বিয়ে করেছে; সে কি নিছকই একটা খেয়াল মাত্র! নিতান্ত উদারতার বশেই কি মাঝি-ব্যাপারীদের গরানকাঠের পঁচিশ বন্দের ঘর, ভারী ভারী মকরমুখী পালঙ্ক, কঁসার বাসন, দোফসলা জমির লোভ ছেড়ে নিকারীদের পচা ধসা বাড়ি, অভাব, হতাশা, দারিদ্রের টানে সে ছুটে গিয়েছিল?
কাত হয়ে একবার দেখল রসুল। আজিমা ঘুমুচ্ছে। নিশ্বাসের তালে তালে সুডৌল বুকটা উঠছে, নামছে। রসুল ভাবল, দুবেলা বাপজানের বাড়িতে ঠিকমতো খেতে না পেয়েও আজিমা যে কোথা থেকে এমন অফুরন্ত যৌবন জোটাল, সেটাই এক বিস্ময়ের ব্যাপার। এ ভাবনাটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আগের ভাবনাটা মনের মধ্যে আরও স্পষ্ট হল। রক্ত-মাংস, হাত-পা, ইন্দ্রিয়গ্রাম, যৌবন, স্বাস্থ্য, রূপ নিয়ে যে কোনও একটি খুবসুরৎ মেয়েই তো সাদির পর তার পাশে এসে দাঁড়াতে পারত! দুনিয়ার এত মেয়ে থাকতে আজিমার জন্যেই বা কেন তার পক্ষপাত! রসুল ভাবে, তিনটি বছর ফেচুপুর গ্রামের মাঠে ঘাটে, আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে একটা খবর সে যোগাড় করেছিল। নিকারীপাড়ার মেয়েরা নোনা ইলিশের সঙ্গে এমন কিছু মেশায়, যাতে পচন-গলন লাগে না। নিকারীদের ব্যবসার মগজ নেই। তাই ব্যবসার এমন মন্ত্রগুপ্তি জানা সত্ত্বেও সারা বছর তাদের পাড়ায় হতাশা, দারিদ্র আর মড়ক চক্কর মেরে বেড়ায়। নিকারীদের একটি মেয়েকে সাদি করে এনে যদি মাছের পচা-গলা রোধ করার অমোঘ কায়দাটা শিখে নেওয়া যায়, তা হলে রসুল দোজখ-বেহস্ত-ঘেরা দুনিয়ার মাঝখানে তার নোনা ইলিশের কারবার ছড়িয়ে ফেলতে পারবে। পদ্মা কি মেঘনার তিরিশ-চল্লিশ হাত জলতল থেকে একান্তে অবলীলায় ইলিশ মাছ তুলে আনে রসুল। কিন্তু নিকারীদের মেয়ে বোধহয় মেঘনা-পদ্মার ইলিশের চেয়েও গভীরচারী। সহজে আজিমা ধরা দেয় না। ব্যাবসার গোপন খবরটা জানায় না। আচ্ছা রসুলও পাকা ইলশা-মাঝি, সে-ও দেবে নেবে নিকারীদের মেয়ের দৌড় কত? দেখবে, কবে সে তার জালে ধরা দেয়?