ছইয়ের মধ্যে বিবিজান মিঞা সাহেবকে ধমকাচ্ছে এই নৌকায় উঠলেন ক্যান মিঞা? কোরায়া-ঘাটায় কি আর মাঝি ছিল না?
মিঞা সাহেব বিব্রত হল। ফিসফিস গলায় বিবিজানকে সামলাতে লাগল : চুপ চুপ বিবি। মাঝি শুনতে পাই। মাঝনদীতে মাঝিরে ক্ষ্যাপাইলে উপায় থাকব না। জান পরাণ যখন তার হাতে। বাঁচাইলে সে, মারলেও সে।
তার আমি কী জানি! পারে নাইম্যা নৌকা বদল করেন।-বিবিজান আবার ঝামটা দিল? এই নৌকায় যামু না।
ভুরু কুঁচকে, বাঁ চোখটা ছোট করে রসুল মাঝি তাকাল। ভাবল, মেঘনা নদীর সঙ্গে তার কতকালের মহব্বত। কোথায় কোন ঘূর্ণি রয়েছে, কোথায় কয় বাঁও জল, কোথায় চোরাঘুর্ণির ফাঁদ পাতা রয়েছে, সব–সবকিছু তার জানা। ইচ্ছে করলেই বিবিজানের চোখের পলক পড়বার আগেই তার বদখত মেজাজটাকে ঠান্ডা করে দিতে পারে রসুল। ছোট্ট এক-মাল্লাই নৌকোটাকে ডুবিয়ে দিতে কতক্ষণই বা লাগে। মেঘনা নদীর মাঝি। সওয়ারি ডুবিয়ে দাঁতে নৌকোর রশি চেপে একটা কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে এক সময় পারে উঠতে সে পারবেই।
ব্যঙ্গভরা গলায় রসুল মাঝি বলল, বিবিজান যেন আমার নৌকাটার উপুর জবর গোঁসা হইছেন। নৌকাটা কি কসুর করল?
ধড়ফড় করতে করতে ছইয়ের মুখে চলে এল মিঞা সাহেব : কিছু না, কিছু না মাঝি। বিবি ছেলেমানুষ। কী কইতে কী কয়, ঠিক নাই। তুমি ইদিকে কান দিও না। যেমুন বাইতে আছ, তেমুন বাও।
বিবি ছেলেমানুষ! মিঞা সাহেবের দিকে এতটুকু লক্ষ নেই রসুল মাঝির। তার চোখ দুটো ছইয়ের মধ্যে বিবিজানকে তল্লাশ করতে লাগল।
মিঞা সাহেব সমানে তোয়াজ করতে লাগল : তুমি কিছু মনে কইরো না মাঝি। হে-হে, বিবির আমার মাথার ঠিক নাই।
রসুল মাঝি জবাব দিল না।
ছইয়ের মধ্যে ঢুকে বোরখা খুলে ফেলেছে বিবিজান। ডুরে শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে একরাশ ঘন চুল, দুটি সুর্মা-আঁকা ঘনপক্ষ্ম চোখ, নাকে সোনার বেশর আর একটি শ্যামলা রঙের মিষ্টি মুখ দেখা যায়। সে মুখ সরস লাবণ্যে ঢলঢল করছে। আড়চোখে চেয়ে রয়েছে বিবিজান। দেখতে দেখতে ভয়ানক চমকে উঠল রসুল মাঝি। কণ্ঠার ফাঁকে অসহ্য যন্ত্রণা। বুকের মধ্যে একটা শক্ত থাবায় কেউ যেন বাতাস চেপে চেপে ধরছে। তালুটা শুকিয়ে আঠার মতো চটচট করছে।
হালের বৈঠাটা হাতের মুঠি থেকে আলগা হয়ে গিয়েছে। খসে পড়বার আগেই চেপে ধরল রসুল মাঝি। নৌকাটা একটা গোত খেয়ে উজানের দিকে ঘুরে গেল।
মিঞা সাহেব চিৎকার করে উঠল, কী হইল মাঝি। হায় খোদা, এই মাঝগাঙে কি সব্বনাশ হইল!
আস্তে গলায় রসুল মাঝি ধমক দিল, চুপ করেন মিঞা ছাহাব। রসুল মাঝির হাতে বৈঠা থাকতে নৌকা ডুবব না।
ঘন ঘন বৈঠার পাড় দিয়ে উজানের দিক থেকে নৌকাটাকে ভাটির মুখে ঘুরিয়ে দিল রসুল মাঝি তার পর হালের বৈঠাটি চেপে আবার ডোরায় এসে বসল।
ডুরে শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে একরাশ ঘন চুল, দুটি সুর্মা-আঁকা চোখ, সোনার বেশর, শ্যামলা রঙের মিষ্টি মুখে সরস লাবণ্য-অনেকদিন আগের আজিমা নামে এক সোহাগ-বউ মনের নিবিড়ে ঘন হয়ে এল। রসুল মাঝি ভাবে, কতকাল আগে আয়ু থেকে, জীবন থেকে সেই মধুর দিনগুলি খসে পড়েছে। কতকাল আগে তারা সত্য ছিল।
সে সব দিনে ইলিশ মাছের মরশুমে পদ্মা আর মেঘনায় পাঁচ মাস ইলশা-জাল বাইত রসুল মাঝি। চার মাস চাটগাঁয়, কক্সবাজারে কি নোয়াখালির গঞ্জে-বন্দরে নোনা ইলিশের কারবার করত। মেটে হাঁড়িতে কাটা ইলিশ নুনে জারিয়ে ঢাকা, কলকাতা কি আরও দূর দূর দেশে চালান দিত। সে সব দিনে রেশমি লুঙ্গি, ডোরাকাটা পিরহান আর বাহারি জুতো পরত রসুল মাঝি। কানে আতর দিত। মাথায় ফুলের তেল দিয়ে পরিপাটি করে টেরি বাগাত। গা থেকে ভুরভুরে গন্ধ বেরুত। ফুরফুরে জীবন। গলায় সিল্কের রুমাল বেঁধে দামি সিগারেট ফুকত। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়ত। কথায় কথায় মেজবান করত। খুশির খেয়ালে মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়ে দিত।
ফেচুপুর গ্রামের কুমারি মেয়েরা বলাবলি করত, দিল বটে একখান! যেমুন ট্যাকা কামায়, তেমুন উড়ায়। অনেকের ঘরেই তো ট্যাকা আছে, কিন্তুক এমুন মন নাই সারা গেরামে।
একা মানুষ, পরাণভরা শখ আর শখ, খেয়াল আর খেয়াল।
কেউ বলে, রসুল মিয়ার চেহারাখানও জবর সোন্দর।
মোট কথা, ফেচুপুর গ্রামের কুমারী চোখগুলিকে মুগ্ধ করেছিল রসুল, কুমারী মনগুলিকে মজিয়ে দিয়েছিল। পাঁচ মাস ইলশা-জাল বাইত, চার মাস চাটগাঁ কি নোয়াখালিতে ব্যাপার করত আর বাকি তিনটে মাস একটা শৌখিন তৃষ্ণার মূর্তি হয়ে শিস দিয়ে দিয়ে ফেচুপুর গ্রামের আনাচে-কানাচে, মাঠে-ঘাটে, ব্যাপারী আর মাঝি-বাড়ির উঠানে দাওয়ায় ঘুরে ঘুরে বেড়াত রসুল।
সব বাড়িতেই রসুলের জন্য কপাট খোলা, দিল দরাজ। সদর-অন্দর একাকার। খাতির-আদরে এতটুকু খুঁত নেই। মীর বাড়িতে দুপুরে মেজবান থাকলে, মৃধা-বাড়ি রাত্তিরে দাওয়াত দেয়। ব্যাপারীরা কোর্মা খাওয়ালে মাঝিরা মোরগ-মুসল্লম ফরমাস করে আনায় গঞ্জ থেকে। শহর-বন্দরের গল্প করতে করতে যখনই রসুল চোখ তোলে তখনই ছিটে বেড়ার জানলার পাশ থেকে চট করে একটা মুখ সরে যায়! সে মুখে শ্যামল আশনাই, সুর্মা-আঁকা চোখ, কানে বনফুল, হাতের পাতায় মেহেদী মাখা, সুডৌল হাতে আয়নাচুড়ি। সব বাড়িতেই জানলার পাশে এক ছবি দেখতে দেখতে চোখ সয়ে গিয়েছে। বলা যায়, অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ওতে আর সাতাশ বছরের কঁচা প্রাণটা আজকাল এতটুকু চঞ্চল হয় না। জানলার পাশে খুবসুরৎ তরুণীর ছবি আপ্যায়নের একটা অঙ্গ হিসাবেই মেনে নিয়েছে রসুল। দূরের আকাশ, নদী, জারুল কি হিজল বনের মতো ওগুলোর আবেদন নিছক নিসর্গশোভা ছাড়া তার কাছে আর কিছু নয়।