বেশ কিছুক্ষণ আগেই সকাল হয়েছে। শীতের মায়াবী রোদে মেঘশূন্য আকাশটাকে অলৌকিক মনে হচ্ছে।
কটা শঙ্খচিল অনেক উঁচুতে, আকাশের নীলের কাছাকাছি, ডানা মেলে অলস ভঙ্গিতে হাওয়ার ভেসে বেড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে কোনও জাপানি চিত্রকরের আঁকা একটি ছবি যেন।
বেডরুমে সিঙ্গল-বেড খাটে হেলান দিয়ে দুরনস্কর মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সুশোভন। হাতের কাছে একটা টি-পয় টেবিলে সাজানো রয়েছে আজকের মর্নিং এডিশরে বগুলো খবরের কাগজ, অ্যাশ-ট্রে, সিগারেটের প্যাকেট, এইটার আর এক কাপ চা।
কুক-কাম-বেয়ারা সতীশ ঘন্টাখানেক আগে খবরের কাগজ-কাগজ দিয়ে গেছে কিন্তু একটা কাগজেরও ভাজ খুলে এখন পর্যন্ত দেখেনি সুশোন। মেটালের অ্যাশ ট্রেটা ঝকঝকে পরিষ্কার, পোড়া সিগারেটের টুকরো বা ছাই কিছুই তাতে নেই। এমন কি, সতীশ যেভাবে চা দিয়ে গিয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই পড়ে আছে। কাপে একটা চুমুকও দেয়নি সুশোভন। চা জুড়িয়ে জল হয়ে গেছে। ক’দিন ধরে এভাবেই তার সকালটা কাটছে।
অনেকটা সময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার পর আস্তে আস্তে চোখ নামায় সুশোন। একটানা একভাবে বসে থাকার কারণে কোমরে খিচ ধরার মতো একটু ব্যথা ব্যথা লাগছে। অর্থাৎ ব্লড সার্কুলেশনটা ঠিকভাবে হচ্ছে না। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করতে হাত-পা টান টান করে বাঁ দিকে সামান্য কাত হল সুশোভন। আর তখনই ওধারের বেডরুমে মণিকাকে দেখতে পেল। তার আর মণিকার শোবার ঘরের মাঝখানে যে দরজাটা রয়েছে সেটা আধাআধি খোলা। সুশোভন দেখল, মণিকা তারই মতো সিঙ্গল-বেড খাটে হেলান দিয়ে আকাশ দেখছে। তার পাশের টি-পয় টেবিলেও চা জুড়িয়ে ওপরে পড়ে গেছে।
মাসখানেক ধরে রোজ সকালে সুশোভন এবং মণিকার ঘরে এই একই দৃশ্য চোখে পড়ে।
সপ্তাহের অন্য ঘ দিন অবশ্য এভাবে সুশোভনকে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয়। কাটায় কাটায় সাড়ে নটায় অফিসের গাড়ি এসে যায়। তার আগেই শেভ করে, আন এবং ব্রেকফাস্ট চুকিয়ে রেডি হয়ে থাকতে হয়। লাঞ্চের সময় সে ফ্ল্যাটে ফেরে না। ওটা অফিসেই সেরে নেয়।
আজ রবিবার। সপ্তাহের কাজের দিনগুলো প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। কিন্তু ছুটির দিন নিয়েই যত সমস্যা। সময় আর কাটতে চায় না তখন। রেল স্টেশনের
প্ল্যাটফর্মে অপরিচিত যাত্রীদের মতো পাশাপাশি ঘরে তারা চুপচাপ বসে থাকে।
অবশ্য এরকম অস্বাভাবিক গুমোট আবহাওয়া খুব বেশিদিন থাকবে না। এ সপ্তাহেই যে কোনও সময় এলাহাবাদ থেকে মণিকার দাদা অমলের আসার কথা আছে। সে তার বোনকে নিয়ে যেতে আসছে। মণিকা সেই যে চলে যাবে, তার আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। সেটাই হবে সুশোভনের জীবন থেকে তার চিরবিদায়। তারপর আনুষ্ঠানিক ভাবে কোর্টে গিয়ে ডিভোর্সের জন্য দরখাস্ত করবে। ঝগড়াঝাঁটি, হই চই বা পরস্পরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি নয়, শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে দু’জনের চার। বছরের ক্ষণস্থায়ী দাম্পত্য জীবন।
অথচ সুশোভন এবং মণিকা, দু’জনেই ভদ্র, শিক্ষিত। তাদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউণ্ডও চমৎকার। লুও তাদের মধ্যে বনিবনা বা অ্যাডজাস্টমেন্ট ঘটেনি। অমিলের কারণ বা বীজটি রয়েছে তাদের চরিত্রের মধ্যে।
মণিকা খুবই শান্ত, স্বল্পভাষী এবং ইনট্রোভার্ট ধরনের মেয়ে। সে কথা বললে দশ ফুট দূরের লোক শুনতে পায় না। জোরে টিভি বা রেডিও চালায় না সে। চলাফেরার সময় এত আস্তে পা ফেলে যে শব্দই হয় না। চা খায় আলতো চুমুকে— নিঃশব্দে।
বিয়ের পর এই চারটে বছর বাদ দিলে আজন্ম এলাহাবাদেই কেটেছে মণিকার। কলকাতার বাইরে বাইরে নানা প্রভিন্সের নানা জাতের মানুষের কসমোপলিটান পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও সে রীতিমত রক্ষণশীল ধরনের মেয়ে। তাদের বাড়ির আবহাওয়াতেও এই রক্ষণশীলতার ব্যাপারটা রয়েছে। তার মা বাবা বা ভাই-বোনের কেউ পুরনো ধাঁচের পারিবারিক কাঠামো ভেঙে বৈপ্লবিক কিছু ঘটাবার কথা ভাবতে পারে না। তার বাপের বাড়িতে মদ ঢোকে না। ড্রিংক করাটা সেখানে ট্যাবু। উনিশ শতকের সুখী যৌথ পরিবার যেভাবে চলত সেই চালেই তাদের বাড়ি চলছে। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখানো ছাড়া সেখানে বিশেষ কোনও পরিবর্তনের ছাপ পড়েনি।
সুশোভনদের ফ্যামিলি একেবারে উলটো। হই চই, পার্টি, ড্রিংক, ওয়েস্টার্ন পপ মিউজিক, কেরিয়ারের জন্য যতদূর দরকার নামা— এসব নিয়ে তারা মেতে আছে। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে তাদের আস্থা নেই। ছেলেরা চাকরি-বাকরিতে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে সুশোভনের বাবা তাদের আলাদা করে দিয়েছে। নিজের নিজের সংসার বুঝে নাও এবং সুখে থাকো। অন্যের দায় বা সাহায্য, কিছুই নেবার প্রয়োজন নেই। এতে সম্পর্ক ভাল থাকবে। মোটামুটি এটাই হল তাঁর জীবনদর্শন এবং ছেলেদের প্রতি অমূল্য উপদেশ।
এই ফ্যামিলির ছেলে হবার ফলে উত্তরাধিকার সূত্রে পারিবারিক ট্রাডিশানের সব কিছুই পেয়েছে সুশোভন। সে একটা নামকার অ্যাড কোম্পানির টপ একজিকিউটিভ। বড় বড় ফার্মের হয়ে তারা বিজ্ঞাপনের পরিকল্পনা তো করেই, তাছাড়া প্রচুর অ্যাড-ফিল্মও তুলতে হয়।
আজকাল অগুনতি অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কোম্পানি গজিয়ে উঠেছে। কমপিটিশন প্রচণ্ড। বড় বড় ক্লায়েন্টদের হাতে রাখতে হলে প্রায়ই পার্টি দিতে হয়। শুধু হোটেল বা ‘বার’-এ নয়, বাড়িতে ডেকেও মাঝে মাঝে ড্রিংকের আসর বসাতে হয়। এমন কি বড় কোম্পানি ধরে রাখতে হলে অনেক সময় জায়গামতো টাকাপয়সাও দিতে হয়। কারও কারও যুবতী সুন্দরী মেয়ে সম্পর্কে দুর্বলতা রয়েছে। কাজেই দরকারমতো। তারও ব্যবস্থা করতে হয়। যে ছেলেমেয়েদের নিয়ে অ্যাড-ফিল্ম ভোলা হয়, তারা তো প্রায়ই সুশোভনদের ফ্ল্যাটে এসে হানা দেয়। যতক্ষণ তারা থাকে চড়া সুরের ওয়েস্টার্ন মিউজিকের সঙ্গে হুল্লোড় চলে।