কাছেই থানা। সেখানকার পেটা ঘড়িতে তিনটে বাজল। স্মৃতিভারে বিভোর সুনীতি চমকে উঠে পড়লেন। আজই তো বুধবার। উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে স্থির করলেন, স্টেশনে যাবেন। সোমনাথকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবেন, এ জাতীয় চিঠি তিনি পছন্দ করেন না। বাচালতা-চপলতার জন্য তাকে যথেষ্ট তিরস্কার করবেন।
.
একমাত্র গাড়িখানা নিয়ে স্বামী কোর্টে গেছেন। অতএব টাঙা ডেকে স্টেশনে এলেন সুনীতি। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনটা এসে পড়ল। উন্মুখ হয়ে এদিক সেদিক তাকাতেই ডাকটা কানে এল, সুনীতি, সুনীতি
চোখ ফেরাতেই সুনীতি দেখতে পেলেন প্রথম শ্রেণির একটি কামরা থেকে মুখ বাড়িয়ে হাতছানি দিচ্ছেন সোমনাথ। তিরিশ বছর আগের মতোই আছেন তিনি, তেমনই উজ্জ্বল সুদীপ্ত চেহারা। শুধু কিছু চুল সাদা হয়েছে। একরকম ছুটেই গাড়িতে উঠে সোমনাথের মুখোমুখি গিয়ে বসলেন সুনীতি।
হাসি হাসি চোখে তাকালেন সোমনাথ, আমার চিঠি তা হলে পেয়েছিলে?
সুনীতি গম্ভীর হতে চেষ্টা করলেন, না পেলে আর এলাম কী করে।
তা বটে। বলে একটু চুপ করে থেকে সোমনাথ আবার শুরু করলেন, অনেক দিন পর দেখা হল। তা তুমি কিন্তু সেদিনের মতোই সুন্দরী রসের আগরী হয়েই আছ।
কথাটা মিথ্যে নয়। তিনটি ছেলেমেয়ের জননী সুনীতি; বয়সও শতাব্দীর অর্ধেক, কিন্তু দেহে সামান্য একটু ভার পড়া আর কটি চুলের রঙ বদলে যাওয়া ছাড়া প্রায় অষ্টাদশীর মতোই আছেন। রাগ করতে গিয়েও চপল হলেন তিন। তরল গলায় বললেন, ফাজলামি হচ্ছে! আমি না হয় রসের আগরী কিন্তু তুমি? তুমি যে নটবরটি হয়ে আছ!
খুব জব্দ করলে যা হোক।
এরপর এলোমেলো অনেক কথা হল। তার মধ্য থেকে সুনীতি যেটুকু জানতে পারলেন, তা এইরকম। সোমনাথ ইদানীং দিল্লিতে সরকারি কলেজের প্রিন্সিপ্যাল, বিয়ে করেননি। ভৃত্যতন্ত্রের হাতে নিজের সমস্ত দায়িত্ব সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত আছেন।
সব কথা সুনীতি জানতেন না। তার বিয়ের পর থেকে, সেজদির সঙ্গে নিয়মিত চিঠি লেখালেখি হচ্ছে। ইচ্ছা করলে অনায়াসেই এ খবর জানতে পারতেন। কিন্তু সঙ্গত কারণেই ইচ্ছা হয়নি। সেজদিও সোমনাথ সম্বন্ধে একেবারে নীরব থেকেছেন।
সুনীতি বললেন, তা চিরকুমার ব্রত নিলে যে হঠাৎ?
তোমার জন্যে। পদপল্লবে তো আর জায়গা দিলে না।
সুনীতি বিব্রত বোধ করলেন। প্রসঙ্গ বদলের জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, যা আত্মভোলা লোক তুমি; কোনওদিকে হুঁশ নেই। দুপুরবেলা খেয়েছিলে তো?
ওই দেখো, একদম ভুলে গেছি। সোমনাথ হাসলেন।
সুনীতি তাড়াতাড়ি প্ল্যাটফর্ম থেকে মিষ্টি আর ফল কিনে সযত্নে সাজিয়ে দিয়ে বললেন, খাও।
খেতে খেতে সোমনাথ সুনীতির সংসার সম্পর্কে প্রশ্ন করে করে কিছু খবর সংগ্রহ করলেন। তারপর হঠাৎ আড়াই যুগ আগে ফিরে গিয়ে বললেন, বউদির সঙ্গে কলকাতায় তোমাদের বাড়ি গিয়ে কটা দিন কি চমৎকারই না কাটিয়ে এসেছিলাম। মনে পড়ে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিকে গিয়েছিলাম?
সুনীতি চুপ; চোখ নামিয়ে আঙুলে শাড়ির আঁচল জড়াতে লাগলেন।
সোমনাথ আবার বললেন, মনে পড়ে তোমাকে নিয়ে জীবন-মরণ ছবিখানা দেখতে গিয়েছিলাম?
সোমনাথ বলতে লাগলেন, গঙ্গার ধারে দুজনে বেড়াতে বেড়াতে চাঁদ উঠেছিল; তুমি আস্তে আস্তে একখানা গান গেয়েছিল। সে-সব কথা নিশ্চয়ই তোমার মনে নেই?
খুব আছে, খুব আছে। কিন্তু মুখ ফুটে কী করে তা বলেন সুনীতি? হঠাৎ চোখ তুলে তিনি যেন আবিষ্কার করলেন, এই বিকেল পাঁচটাতেই কার্তিকের সন্ধ্যা ঘনতর হয়ে আসছে; হিমেল বাতাস সাঁই সাঁই বয়ে যাচ্ছে। দেখলেন, সামান্য একটা সুতির জামা পরে আছেন সোমনাথ। বললেন, তোমার গরম পোশাক কোথায়?
সোমনাথ একটা সুটকেস দেখিয়ে দিলেন। সেটা খুলে কোট বার করে সুনীতি বললেন, পরে ফেলো।
পরে পরব।
উঁহু, ভুলে যাবে। তারপর ঠান্ডা লেগে এক কাণ্ড বাধাবে।
সোমনাথ খেতে খেতেই কোট পরলেন। সুনীতি বোতাম আটকে দিলেন।
কিছুক্ষণ পরে সোমনাথ আবার বললেন, কী, আমার কথাগুলোর জবাব তত দিলে না–
সুনীতি কী বলতে যাচ্ছিলেন; সেই সময় বাইরে ট্রেন ছাড়ার প্রথম ঘণ্টি পড়ল। দশটা মিনিট কখন কেটে গেছে, কারো খেয়াল নেই। সোমনাথ চকিত হয়ে বললেন, নামো সুনীতি, ট্রেন ছেড়ে দেবে।
সুনীতি বললেন, আরে বাপু, নামছি।
একটু পরেই দ্বিতীয় ঘন্টি পড়ল। কাণ্ডজ্ঞানহীন সোমনাথ এবার এক কাণ্ডই করে বসলেন; হাত ধরে সুনীতিকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে বিপর্যয়টা ঘটে গেল। অভিমানিনী কিশোরীর মতো অবরুদ্ধ সুরে সুনীতি বললেন, চিরদিন আমাকে দূরেই সরিয়ে রাখতে চেয়েছ। সেদিন বিদেশে চলে গেলে। আজও
তার কথা শেষ হতে না হতেই গার্ডের হুইসিল শোনা গেল। ট্রেন ছেড়ে দিল। বিমূঢ় সোমনাথ জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলেন।
একসময় সোমনাথকে নিয়ে ট্রেনটা ডিসট্যান্ট সিগনালের ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেল। আর তখনই আত্মবিস্মৃতির ঘোরটা কেটে গেল সুনীতির। কী করতে এসেছিলেন সোমনাথের কাছে আর এ কী করে গেলেন? নিজের অগোচরে অভিসার করতেই কি বেরিয়েছিলেন সুনীতি? গ্লানিতে, আত্মধিক্কারে নিজের কাছেই অত্যন্ত ছোট হয়ে গেলেন তিনি।
কিন্তু সুনীতি কি জানতেন, সব আগুন নেভে না? ভস্মেই সব আগুনের পরিণাম লেখা নেই? সংসার-সুখ-স্বামী-সন্তান এবং তিরিশটা বছর দিয়ে যে স্ফুলিঙ্গকে তিনি আড়াল করে রেখেছিলেন, কে জানত একটুতেই প্রাণের অতল থেকে ঊর্ধ্বমুখ শিখার মতো তা বেরিয়ে আসবে।
আর একবার – প্রফুল্ল রায়
এই সতেরো তলা হাইরাইজ বিল্ডিংটার টপ ফ্লোরে সুশোভনের ফ্ল্যাট। এখানে যে কোনও জানালায় দাঁড়ালে বিশাল আকাশ চোখে পড়ে। কলকাতার মাথার ওপর যে এত বড় একটা আকাশ ছড়িয়ে আছে, এখানে না এলে টের পাওয়া যায় না।