আমার কানের কাছে মুখ এনে সুকুমার পাল ফিসফিস করে জিগ্যেস করলেন, ভেতরে যাবেন নাকি। যা মূর্তি দেখছি আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে যাবার জোগাড়। সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। চলুন, সরে পড়ি।
সুকুমার যা বললেন, আমারও সেই একই হাল। তবু কেন যেন মনে হল মেয়েমানুষটি আমাদের কোনও ক্ষতি করবে না। তা ছাড়া হাত-পায়ের জোড়গুলো ঢিলে হয়ে গেছে; অনেক চড়াই-উতরাই ভেঙেছি, তাই শিরদাঁড়া যন্ত্রণায় টনটন করছে। ফিরে যে যাব, শরীরে তেমন এক ফোঁটা এনার্জি আর নেই।
মেয়েমানুষটি হিন্দুস্থানীতে কথা বলছিল। কিশোর পাঠকদের পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হবে। তাই দু-চারটে হিন্দি উর্দু রেখে বাকিটা বাংলাতেই লিখছি।
মেয়ে মানুষটি আমাদের লক্ষ করছিল। দুজনের মনোভাবটাও আন্দাজ করে নিয়েছিল। বলল, বেটারা, কী ফুসুর ফুসুর করছিস? বললাম তো ডর নেই। আ যা–আ যা–
আমি খানিকটা সাহস ফিরে পেয়েছিলাম। সামনের দিকে পা বাড়িয়ে দিলাম। সুকুমার পাল আর কী করবেন, তিনিও আমার পেছন পেছন আসতে লাগলেন। তাঁর আসার ভঙ্গিটা দেখে মনে হল যেন বধ্যভূমিতে চলেছেন।
বাড়ির ভেতর ঢোকার পর মেয়েমানুষটি আমাদের যে ঘরটায় নিয়ে এল সেটার মেঝে থেকে চাল অবধি সব কাঠের। দু-ধারের দেওয়াল ঘেঁষে কাঠের চওড়া দুটো মাচা; তার ওপর তোশক; তোশকের ওপর পরিপাটি করে চাদর পাতা। দুই মাচার মাঝখানে চারটে বেতের চেয়ারের মাঝখানে বেতেরই সেন্টার টেবিল।
সেই সময় দক্ষিণ আন্দামানে পোর্টব্লেয়ার ছাড়া অন্য কোথাও ইলেকট্রিসিটি আসেনি। কেরোসিন তেলের হ্যারিকেনই ভরসা। হ্যারিকেনটা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে মেয়েমানুষটি বলল, বেটারা, তোদের দেখে মালুম হচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে থকে গেছিস। বৈঠ বৈঠ, আগে থোড়েসে আরাম কর
নিঃশব্দে আমরা দুটো চেয়ারে বসে পড়ি। এতটাই ক্লান্ত যে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলাম না।
হঠাৎ পাশের কোনও কামরা থেকে ঘুম-জড়ানো গমগমে একটা গলা ভেসে এল।-এ সুলতানা, ইতনি রাতে কাদের সঙ্গে বড়র বড়র করছিস?
মেয়েমানুষটির নাম জানা গেল-সুলতানা। শব্দটার মানে সম্রাজ্ঞী। পৃথিবীর কোনও দেশে এমন চেহারার সম্রাজ্ঞী আদৌ ছিল কিনা, এখনও আছে কিনা, আমার জানা নেই।
সুলতানা ঝঙ্কার দিয়ে উঠল, আরে জনাব, ভইসের মতো ভোস ভোস করে ঘুমাচ্ছ। ইতনা নিদ, ইতনা নিদ! বাইরের কামরায় এসে দেখ, কারা এসেছে।
একটু পরেই ভেতর দিকের একটি ঘর থেকে বিপুল আকারের একটি লোক চলে এল। সুলতানার চেয়ে আরও চার পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। বুকের পাটা কম করে চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ ইঞ্চি। হাত দুটো জানু অবধি নেমে এসেছে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল আর খোঁচা খোঁচা দাড়ির বেশির ভাগই সাদা। পরনে প্রচুর কুচি-দেওয়া ঢোলা ইজের, তার ওপর ফতুয়া ধরনের জামা। চোখ দুটো ঢুলু ঢুলু, আধবোজা। বোঝা যায়, ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি।
সুলতানা এইভাবে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। এ হল দিল্লিবালা ধরম সিং; হিন্দু। আর আমি হলাম পাঠান। তিশ সাল ধরম সিংয়ের ঘরবালী হয়ে সংসার করছি। –এরা রাস্তা ভুল করে ঘুরতে ঘুরতে এখানে চলে এসেছে।
আগেই জেনেছি আন্দামানে নানা রাজ্যের এবং নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু নিজের চোখে এমন একজোড়া স্বামী-স্ত্রী দেখলাম। কিছুটা অভব্যের মতো অবাক হয়ে দুজনকে দেখতে থাকি।
ধরম সিং আমাকে লক্ষ করছিল। তার ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেল। ডান ধারের দেওয়াল ঘেঁষে তোশক-পাতা যে কাঠের মাচাটা রয়েছে তার ওপর জম্পেশ করে বসে বলল, আরে ভেইয়া তাজ্জব বন গিয়া কিয়া? লেকিন তাজ্জবের কারণ নেই। আংরেজ সরকার এরকম হাজারো শাদি দিয়েছে। এই যেখানে এসেছ এটার নাম টুগাপুর। এখানে পঁচিশটা ফ্যামিলি আছে। হিন্দু-মুসলমানে ঘর করছে, খ্রিস্টান শিখে ঘর করছে, বঙ্গালি বর্মীর ঘর আছে। এ এক আজীব জাজিরা (দ্বীপ)। সমঝ লো, এখানে সব হয়।
দু-এক মিনিটের আলাপেই টের পেলাম ধরম সিং মানুষটা বেশ মজলিশি ধরনের। জমিয়ে গল্প করতে ভালোবাসে। সে বলতে লাগল, বত্তিশ সাল আগে আমি দায়ের কোপে তিন আদমির মুন্ডি নামিয়ে সেলুলার ফাটকে কালাপানি খাটতে আসি। ওই যে সুলতানাকে দেখছ, সে-ও দো মুন্ডি নামিয়ে জেনানা ফাটক সাউথ পয়িন্ট এসেছিল। চাকুর ঘা খেয়ে তার বদনের কী হাল হয়েছে দেখেছ তো; গালের একদিকের সব দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। কালাপানি এসে আমরা কেউ ঝামেলা ঝঞ্ঝাট করিনি। তাই আংরেজ সরকার আমাদের সাথ আরও বহোৎ আদমির শাদি দিয়ে ফরিন ডিপাটে (ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে) নৌকরি দিয়ে টুগাপুরে পাঠাল। নৌকরির মিয়াদ খতম। আমরা দুজন এখন পুরা পাঁচ হাজার রুপাইয়া পেনশন পাই।
আমাদের ব্যাপারে ধরম সিংয়ের এতটুকু আগ্রহ নেই। সে নিজেদের সম্বন্ধে, পুরোনো দিনের আন্দামান সম্বন্ধে সাতকাহন ফাঁদতে যাচ্ছিল, হঠাৎ সুলতানার কী খেয়াল হতে ধরম সিংকে থামিয়ে দিয়ে আমাদের দিকে তাকাল।–বেটা, তোমরা তো পুটবিলাস (পোর্টব্লেয়ার) থেকে আসছ। কখন ওখান থেকে বেরিয়েছিলে?
সুকুমার পাল বললেন, বিকেলে
এখন তো আধি রাত। কুছু খানা টানা জুটেছে?
করুণ চোখে সুলতানার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নামিয়ে আস্তে আস্তে নাড়তে লাগলেন সুকুমার।
ব্যস্তভাবে উঠে পড়ল সুলতানা। ধরম সিংকে বলল, বড়র বড়র না করে বেটাদের পানি এনে দাও। হাতমুখ ধুয়ে নিক। আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে আসছি। সে বাইরের ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।