কিছুক্ষণ এই রকম চলল। কুকুরগুলো কী ভাবল, কে জানে। তাদের মারমুখো তেরিয়া মেজাজ আর নেই। চিৎকারও থেমে গেছে; দূরে সরে গিয়ে তারা কুই কুঁই করতে থাকে।
সারা জীবনে কত জায়গায় ঘুরেছি। কিন্তু কুকুর বশ করার এমন কায়দা আর কারোর দেখিনি।
সুকুমার পাল বললেন, কুকুরগুলো বেয়াড়া, বেআদব নয়। মানুষের সঙ্গে থাকে তো। তাই আমার কথাগুলো বুঝতে পেরে সরে গেছে।
লোকটাকে যত দেখছি, তার কথা যত শুনছি ততই অবাক হচ্ছি।
সুকুমার পাল এবার সামনের দিকে একটু দূরে আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।–ওই দেখুন!
সেই সন্ধের পর থেকে অল্প অল্প কুয়াশা পড়তে শুরু করেছিল। এখন তা বেশ গাঢ় হয়ে উঠেছে। কুয়াশা ভেদ করে যে চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে এসে পড়েছে সেটা রীতিমতো ঘোলাটে। সেই আলোতে কুড়ি বাইশটা কাঠের বাড়ির অস্পষ্ট কাঠামো চোখে পড়ল। সেগুলো কাছে-দূরে ছাড়া ছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সুকুমার পাল বললেন, কপাল ভালো, তাই কুকুরগুলো ডেকে উঠেছিল। নইলে এত রাত্তিরে বসতিটার কথা জানতে পারতাম না।
কুকুরের হল্লা শুনে যিনি একটি লোকালয়ের হদিস পেতে পারেন তাঁকে আমি কিনা বদ্ধ পাগল ভেবেছিলাম। ভেতরে ভেতরে বিব্রত বোধ করলাম। ওইরকম ভাবাটা অন্যায় হয়ে গেছে।
সুকুমার বললেন, চলুন যাওয়া যাক। বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে ব্রিটিশ আমলে তৈরি।
বললাম, আলো-টালো তো কিছু দেখা যাচ্ছে না।
এই মাঝরাতে ঝাড়লণ্ঠন জ্বালিয়ে কেউ ঘুমোয় নাকি?
পায়ে পায়ে সুকুমার পালের সঙ্গে এগিয়ে যাই। খাবার-দাবারের আশা যে নেই সে ব্যাপারে আমি শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত। শরীর ভেঙে আসছে। বাকি রাতটুকুর জন্য যদি একটা আস্তানা জোটে তাই যথেষ্ট। জুটবে যে এমন ভরসা নেই।
প্রথম যে বাড়িটা পাওয়া গেল সেটার রাস্তার দিকে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কুকুরগুলো খুব সম্ভব এই এলাকার পাহারাদার। তারা পিছু পিছু এসে একটু দূ রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের লক্ষ করতে লাগল। কিন্তু কোনও রকম চিৎকার জুড়ে দিল না। কুকুরের মনস্তত্ত্ব আমার জানা নেই। মনে হয়, আমাদের হাল দেখে তাদের কিঞ্চিৎ সহানুভূতি হয়ে থাকবে।
একটু ইতস্তত করে সকুমার পাল দরজার কড়া নাড়লেন। প্রথম দিকে আস্তে আস্তে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না।
অগত্যা জোর লাগাতে হল। একটানা খটখটানি চলছেই।
আচমকা দরজার পাল্লা ভেদ করে তীব্র বাজখাঁই একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল।–কৌন রে কুত্তা? কৌন হো?
একসঙ্গে দশটা জগঝম্পর সঙ্গে দশটা ফাটা কাঁসর পেটালে যে শব্দ বেরোয়, অনেকটা সেইরকম।
আঠারোশো সাতান্নয় সিপাহি বিদ্রোহের পর মিরাট, কানপুর, লখনৌ ইত্যাদি শহর থেকে বিদ্রোহী সেনাদের ধরে ইংরেজরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়ে কালাপানি অর্থাৎ আন্দামানে পাঠায়। তারা হিন্দি আর উর্দু মেশানো যে ভাষাটি বলত সেটাকে বলা হয় হিন্দুস্থানী বুলি। স্বাধীনতার পর অনেকদিন পর্যন্ত সেই বুলিটি চালু ছিল।
বাড়ির ভেতর থেকে সেই কণ্ঠস্বরটি মুহুর্মুহু বেরিয়ে আসছে।আবে উল্লুকা পাঠঠে, খামোস কিউ? বাতা-বাতা
গলাটা কোনও পুরুষ না মহিলার বুঝতে পারছি না। তবে এর আগে এমন তীব্র বিকট কণ্ঠস্বর আর কখনও শুনিনি। ইহজন্মে আর শুনব কিনা, জানি না। আমার হৃৎকম্প শুরু হয়ে গিয়েছিল।
ওদিকে সুকুমার পাল দরজার কড়া দুটো ধরে রেখেছিলেন ঠিকই, তবে তাঁর হাত থর থর কাঁপছিল। মিয়োনো গলায় তাঁর ভাঙা ভাঙা ফরিদপুরি হিন্দিতে সুকুমার জবাব দিলেন, আমরা দু-লোক হ্যায়। তারপর তড়বড় করে যা বললেন তা এইরকম। তিনি এবং আমি পাহাড়ি রাস্তায় পথ হারিয়ে এদিকে চলে এসেছি। এত রাত্তিরে দরজা খটখটিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে তখলিফ দেওয়া হয়েছে, সেজন্য মাফি মাঙছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি।
থোড়েসে ঠহর যা
মিনিট তিনেক পর দরজা খুলে গেল। গলা শুনে আমার হৃৎকম্প শুরু হয়েছিল। তাকে দেখে আচমকা হৃৎপিণ্ডটা এক লাফে গলার কাছে উঠে এল। প্রায় দু-ফিটের মতো লম্বা এবং ইয়া চওড়া তাগড়াই একটি মেয়েমানুষ। হাতের পাঞ্জা দুটো যেন বাঘের থাবা। কাঁচা পাকা, উশকো খুশকো, রুক্ষ চুল ঝুঁটিবাধা। চোখের তারা দুটো কটা। পরনে ঘাঘরা আর ঢলঢলে ব্লাউজ। দুটোই কোঁচকানো মোচকানো। ঘুম থেকে উঠে এসেছে তাই পোশাকের হাল ওইরকম।
মেয়েমানুষটির হাতে একটা হ্যারিকেন। তার আলোয় দেখা গেল তার বাঁ-গালের ঠোঁট থেকে প্রায় কানের কাছাকাছি অবধি গালের আধাআধি অংশের মাংস নেই। ফলে ওই দিকটার দু-পাটির সব দাঁত বেরিয়ে পড়েছে।
মনে হল রামায়ণ কি মহাভারতের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে কোনও অতিমানবী বা দানবী আমাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আমার একটু আগে ছিলেন সুকুমার পাল। তাঁর গলা থেকে আঁক করে একটা আওয়াজ বেরুল। পরক্ষণে লাফ দিয়ে তিনি আমার পেছন দিকে চলে এলেন। আমার এমন বুকের পাটা নেই যে ওই দানবীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। লাফ দিয়ে আমিও সুকুমারের পেছনে চলে গেলাম। তিনি পাক খেয়ে আমার পেছনে চলে গেলেন। এইভাবে সামনে-পেছনে বারকয়েক লাফঝাঁপ চলল।
মেয়েমানুষটির বোধহয় মজা লাগছিল। কটা চোখ দুটো কৌতুকে চিকচিক করছে। এবার সে ভারী নরম গলায় বলল, ডারো মাত্ বেটা, অন্দর আও
যার গলার ভেতর থেকে এই কিছুক্ষণ আগে বিকট বাজখাই স্বর বেরিয়ে আসছিল তার গলা কয়েক মিনিটের মধ্যে এমন মোলায়েম হয়ে যাবে, কে ভাবতে পেরেছিল।