মনে পড়ে সবার মতো তার সঙ্গেও সোমনাথের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন সেজদি। তখন তার কত আর বয়স? খুব বেশি হলে অষ্টাদশীই হবেন। চোখ বড় বড় করে সোমনাথ বলেছিলেন, বোনটি তত তোমার খাসা দেখছি বউদি।
প্রথম পরিচয়ের দিন এভাবে কেউ বলতে পারে, ভাবা যায়নি। মুখ লাল হয়ে উঠেছিল সুনীতির। লজ্জায় জড়সড় হয়ে চোখ নামিয়ে নিয়েছিলেন।
সেজদি ঠোঁট টিপে হেসেছিলেন, তোমার যেন খুব মনে ধরেছে–
ধরেছে বলে ধরেছে। ওই যে কী বলে, মুনিগণ ধ্যান ভাঙি দেয় পদে তপস্যার ফল–সেই রকম দেখতে।
সুনীতি আর বসে থাকতে পারেননি; ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
সেবার মাসখানেকের মতো থেকে গিয়েছিলেন সেজদি। অগত্যা সোমনাথকেও থাকতে হয়েছিল। চলে যেতে অবশ্য চেয়েছিলেন, বাবা-মা একরকম জোর করেই ধরে রেখেছিলেন।
দিন কয়েক সবাইকে নিয়ে মাতামাতির পর সোমনাথের সমস্ত মনোযোগ এসে পড়েছিল তার ওপর। সর্বক্ষণ তাকে প্রায় ঝালাপালা করে রাখতেন সোমনাথ। এমন একেকটা কথা বলতেন, রসিকতা করতেন যে লজ্জায় সুনীতির মাথা কাটা যেত।
এমনিতেই তার বাপের বাড়ির সংসারটা ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল; মেয়েদের চলাফেরার ব্যাপারে চারদিকে অনেক গন্ডি কাটা ছিল। কিন্তু সোমনাথ আসার পর কড়াকাড়ি বেশ আলগা হয়ে গিয়েছিল। অন্তত সুনীতির পক্ষে।
সোমনাথের আগ্রহে সবাই মিলে একদিন বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়া হয়েছিল পিকনিক করতে। তাছাড়া প্রায়ই কলকাতার একটা করে দর্শনীয় জায়গায় বেড়াতে যেতে হত। অবশ্য রোজ সবার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হত না। তবে সেজদি আর সুনীতি সোমনাথের সঙ্গে বেরুতেনই।
সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার, একদিন সোমনাথ একলা তাকে সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। আরেকদিন নিয়ে গিয়েছিলেন গঙ্গার ধারে। এর আগে দাদা বউদি বা মায়ের সঙ্গে ছাড়া বাড়ির বাইরে একটি পা-ও বাড়াননি। সোমনাথের সঙ্গে বেরুতে গিয়ে লজ্জায়, কুণ্ঠায় আর খুশিতে হৃৎপিণ্ডে এস্রাজে ছড় টানার মতো কিছু একটা হচ্ছিল যা ঠিক মুখের কথায় বোঝানো যায় না। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিলেন সুনীতি; সোমনাথের সঙ্গে বেরুতে কেউ আপত্তি তো করেনইনি, বরং সবাই যেন খুশিই।
ঘরে-বারান্দায় খিলানে-অলিন্দে–বাড়ির সর্বত্র একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছিল। গুঞ্জনটা যে তাকে আর সোমনাথকে ঘিরে, একটু কান পাতলেই তা টের পাওয়া যেত। একটি রমণীয় পরিণামের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন সবাই।
মনে আছে সে-সময় কারো দিকে তিনি তাকাতে পারতেন না। শুধু মনে হত ঘুমঘোরে সুখের এক সরোবরে রাজহংসীটির মতো ভেসে বেড়াচ্ছেন।
শুধু বাইরে বেরুনোই নয়, সেজদি আরেক বিপদে ফেলেছিলেন। তার দেবরটি নাকি ভীষণ খেয়ালি, আত্মভোলা গোছের। তার খাওয়া-দাওয়া-স্নান ঠিক মতো হচ্ছে কিনা তা সুনীতিকেই দেখতে হবে। অতএব বাবুর ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই চায়ের পেয়ালাটি নিয়ে শিয়রে দাঁড়াতে হত। স্নানের জন্য সকাল দশটা থেকেই তাগাদা দিতে হত। সময়টা ছিল কার্তিক মাস। ছাদে বসে হিমের মধ্যে রাতের দুটো প্রহরই হয়তো বাঁশি বাজিয়ে গেলেন সোমনাথ, তাড়া দিয়ে তাকে শুতে পাঠাতে হত।
দেখতে দেখতে একটা মাস কেটে গিয়েছিল। একটা মাস বা দীর্ঘ তিরিশটা দিন নয়; মনে হয়েছিল একটা মাত্র নিমেষ। ভোরের বাতাসে বয়ে আসা এক ঝলক সৌরভের মতো দিনগুলো কখন কীভাবে ফুরিয়ে গেছে তা যেন টের পাওয়া যায়নি। যাই হোক, সেজদিরা আর থাকতে পারলেন না। তাদের পাঞ্জাবে ফিরে যেতে হল।
মনে আছে, যাবার আগের দিন ছাদের নিভৃত কোণে দাঁড়িয়ে সামনাথ বলেছিলেন, কাল চলে যাচ্ছি; তবে হৃদয়খানা কলকাতাতেই রেখে গেলাম।
খুব খারাপ লাগছিল সুনীতির; ভয়ানক কান্না পাচ্ছিল। মাত্র কয়েকটা দিনের মধ্যেই সোমনাথ তাঁর প্রাণে গভীর রেখায় কীসের একটা ছাপ ফেলে দিয়েছেন। কঁপা শিথিল সুরে সুনীতি জিগ্যেস করেছিলেন, আবার কবে দেখা হবে?
মাঝখানে বাবা-মা একবার আসবেন। তারপর একেবারে টোপর মাথায় দিয়ে আমার আবির্ভাব হবে। তখন দেখা হবে।
সুনীতি আর কিছু বলতে পারেননি। শুধু মনে হয়েছিল হৃৎপিণ্ড উচ্ছলিত হয়ে কোথায় যেন ঢেউ উঠেছে।
সোমনাথেরা চলে যাবার পর পাঞ্জাব আর কলকাতায় দুপক্ষের অভিভাবকদের মধ্যে বিয়ের ব্যাপারে চিঠি যাওয়া-আসা করেছে। সুনীতি আশায় আশায় থেকেছেন। কিন্তু মাস ছয়েক পর হঠাৎ খবর এসেছিল দুর্লভ একটা স্কলারশিপ পেয়ে সোমনাথ লন্ডন চলে গেছেন। গবেষণার জন্য সেখানে তাঁকে বছর কয়েক থাকতে হবে। শুনে সুনীতি নিভৃতে বসে নীরবে শুধু কেঁদেছেন।
সোমনাথ কবে ফিরবেন তার স্থিরতা নেই। সুতরাং বাবা-মা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারেননি। অন্য ছেলের সন্ধান করে তার বিয়ে দিয়েছেন। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে উত্তর প্রদেশের এই শহরে চলে এসেছেন সুনীতি। তারপর লম্বা তিরিশটা বছর কেটে গেছে। এখন তিনি পরিপূর্ণ সংসারের মাঝখানে রাজেন্দ্রাণী হয়ে আছেন। সুখ-সৌভাগ্য-বাড়ি-গাড়ি-পরিতৃপ্তি, কোনও কিছুর অভাব নেই। জীবন তার দুহাত ভরে অজস্র দিয়েছে।
সবাই বলে তিনি গম্ভীর, অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী। সোমনাথের সঙ্গে জড়ানো সেই একটা মাস নিতান্তই ছেলেমানুষি; অতএব অনাবশ্যক। এই তিরিশ বছরে একবারও সে-কথা তিনি স্মরণ করেননি; সেদিনের স্মৃতিকে প্রশ্রয় দেবার মতো কোনও কারণও খুঁজে পাননি সুনীতি।