সুকুমার পাল হাহাকার করে উঠলেন।-সর্বনাশের মাথায় বাড়ি। রায়বাবু গাড়িতে এক্সটা চাকা নেই যে বানচাল চাকাটা পালটে দেব। সারারাত এই গাড়ির ভেতর বসে থাকতে হবে। কাল সকালে আলো ফুটলে রাস্তায় লোকজন দেখা গেলে একটা উপায় হতে পারে।
সুকুমার যা যা বললেন তার কোনওটাই সুখকর নয়। এই নিঝুম, জনমানবহীন পাহাড় জঙ্গলে ঘেরা দক্ষিণ আন্দামানে সমস্ত রাত বিকল জিপে বসে বসে জেগে কাটাতে হবে, ভাবতেই ভীষণ দমে যাই।
সুকুমার এবার বললেন, একটাই সমস্যা। মারাত্মক খিদে পেয়েছে। পেটের ভেতর একেবারে খাণ্ডবদাহন চলছে।
তাঁর কথায় খেয়াল হল, আমারও খিদেটা চনচনে হয়ে উঠেছে। বাকি রাতটা না জুটবে এক টুকরো রুটি বা একমুঠো ভাত। ব্যাপারটা খুব আনন্দদায়ক নয়। কিন্তু কী আর করা?
সুকুমার পাল থামেননি, দেখুন ভাই, গান্ধীজি মাঝে মাঝেই অনশনে বসতেন। দেশপ্রেমী যতীন দাস একটানা ছাপ্পান্ন না সাতান্ন দিন অনশন করেছিলেন। পট্টি রামালু ষাট না বাষট্টি দিন অনশন করে সেকালের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিটা ভেঙে তেলুগুভাষীদের জন্যে আলাদা অন্ধ্রপ্রদেশটা আদায় করে ছেড়েছিলেন। আর আমরা একটা রাত উপোস দিয়ে থাকতে পারব না? খুব পারব! এরপর ফি মাসে দু-চারদিন উপোস করলে শরীরস্বাস্থ্যের পক্ষে সেটা কতটা উপকারী সে সম্বন্ধে লম্বা-চওড়া একটা ভাষণ দিলেন।
বানচাল জিপে বসে সময় কাটতে থাকে। ঘণ্টাখানেক পর সুকুমার পাল হঠাৎ বলে ওঠেন, নাহ, পেটের ভেতর খিদেটা জ্বালিয়ে মারলে দেখছি। মনে হচ্ছে নাড়িভুড়ি জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। আর তো পারি না। কিছু একটা না করলেই নয়।
এই লোকটাই না খানিকক্ষণ আগে উপবাসের উপকারিতা সম্পর্কে সাতকাহন কেঁদে বসেছিলেন? জিগ্যেস করলাম, এই নির্জন জায়গায় কী করতে চান?
সুকুমার পাল সামান্য ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, কী আবার করব? খাবার-দাবারের খোঁজ করতে হবে না?
কিছুক্ষণ আগে যা যা বলেছিলেন বেমালুম ভুলে গেছেন সুকুমার পাল। বললাম, এখানে। খাবার কোথায় পাবেন?
চেষ্টা করতে হবে। কথায় বলে না যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। গাড়ির ভেতর বসে বসে অনাহারে প্রাণত্যাগ করাটা কাজের কথা নয়। নামুন নামুন। দেখা যাক আশেপাশে কোনও বসতি পাওয়া যায় কিনা।
সুকুমার নেমে পড়লেন। অগত্যা আমাকেও নামতে হল। মেটে মেটে চাঁদের আলোয় আমাকে পাশে নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা শুরু করলেন সুকুমার। বললাম, গাড়িটা রাস্তায় পড়ে রইল। আমার স্যুটকেস-ট্যুটকেস যে থেকে গেল। হঠাৎ কেউ এসে পড়লে তো সর্বস্ব খোয়া যাবে।
সুকুমার আমার দুশ্চিন্তা প্রায় তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দিলেন।-আরে ভাই, আন্দামান আর যাই হোক, বম্বে দিল্লি কলকাতা নয়। এখানে দু-চারটে খুনখারাপি হতে পারে কিন্তু চুরিচামারির মতো ছ্যাচড়া কাজ কেউ করে না। চুরি-টুরিকে এখানকার লোক ঘেন্না করে। কেউ এসে পড়লেও জিপ বা আপনার জিনিসপত্রের দিকে ফিরেও তাকাবে না—
উঁচু নীচু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হাঁটু আর গোড়ালি আলগা হয়ে যাবার উপক্রম। কোমর টনটন করছে। যে পথটা ধরে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে হাঁটছি সেটা এক জায়গায় এসে দু ভাগে ভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। হাঁপাতে হাঁপাতে বলি, আর যে চলতে পারছি না।
সুকুমার বেশ দমে গেছেন। তিনিও দাঁড়িয়ে পড়েছেন। বললেন, আমারও তো একই হাল। শরীর যেন ভেঙে পড়ছে।
আমি কী বলতে যাচ্ছিলাম, আচমকা ডান ধারের রাস্তাটা থেকে এক পাল কুকুরের ডাক ভেসে এল।
মরা মরা জ্যোৎস্নায় সুকুমার পালের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। বিপুল উৎসাহে বলে উঠলেন, আছে আছে আলো আছে। ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। এত হাঁটাহাঁটির রিওয়ার্ড এবার পাওয়া যাবে।
তাঁর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। চড়াই উতরাই ভাঙতে ভাঙতে লোকটার মাথা কি খারাপ হয়ে গেল! হাঁ করে সুকুমার পালের মুখের দিকে কয়েক লহমা তাকিয়ে থেকে বললাম, কীসের আলো? কীসের রিওয়ার্ড?
সুকুমার পাল বললেন, কুকুরগুলোর ডাক শুনতে পাচ্ছেন না?
কুকুরের ডাকের মধ্যে কতটা আশা, কতটা রিওয়ার্ড জড়িয়ে আছে, বুঝতে পারছি না। ধন্দ-ধরা মানুষের মতো বললাম, তা তো পাচ্ছি। কিন্তু
আরে ভাই, একসঙ্গে এতগুলো কুকুর যখন চেঁচাচ্ছে তখন কাছাকাছি নিশ্চয়ই কোনও বসতি-টসতি আছে। রাস্তার ধার ঘেঁষে কটা মাঝারি হাইটের ডালপালাওয়ালা ঝাঁকড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। সুকুমার দুটো ডাল ভেঙে নিয়ে একটা নিজের হাতে রাখলেন, অন্যটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন।
জিগ্যেস করলাম, এই ডাল দিয়ে কী হবে?
লাঠির কাজ করবে।
মানে?
যেখানে কুকুর ডাকছে আমরা সেদিকে যাব। ওরা তো এই মাঝরাতে আমাদের আদর করে অভ্যর্থনা জানাবে না। তখন লাঠির দরকার হবে। চলুন–
বিশ্বজিৎ রাহা মনে হয় এক বদ্ধ উম্মাদের হাতে আমাকে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। সুকুমার পালের পাশাপাশি ডান দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম।
বেশিক্ষণ নয়, মিনিট দশেক হাঁটার পর এক দঙ্গল কুকুর তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে আমাদের দিকে তেড়ে এল। আমাকে বিশেষ কিছু করতে হল না। সুকুমার পাল বাই বাই করে হাতের ডালটা ঘোরাতে লাগলেন। আর আদুরে সুরে বলতে লাগলেন, হট-হট। কেন চেল্লাচিল্লি করছিস? আমরা ডাকু না খুনি? দেখছিস না ভদ্দরলোক।