রাস্তাটা কখনও পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠছে, কখনও নীচে নামছে। আমাদের জিপটা একের পর এক চড়াই উতরাই ভেঙে পাহাড়ি পথে পাক খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে।
বিকেলবেলায় আমরা বিশ্বজিৎ রাহার বাংলো থেকে বেরিয়েছিলাম। এখন সন্ধে নামতে শুরু করেছে। সূর্যটাকে আকাশের কোথাও আর দেখা যাচ্ছে না। যেদিকে যতদূর চোখ যায়, সব ঝাপসা ঝাপসা। কোথাও মানুষজন চোখে পড়ে না। সব নিঝুম। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিদের কোরাস আর গাছের আড়াল থেকে অজানা বুনো পাখিদের ডাক ভেসে আসছে। মনে হয় আমাদের চেনাজানা এই পৃথিবীর বাইরে সৃষ্টিছাড়া জনমনুষ্যহীন এক গ্রহে এসে পড়েছি। কেমন যেন গা ছমছম করে।
আন্দামানে আসার পর লক্ষ করেছি, বছরের এই সময়টা সন্ধে নামার অল্প কিছুক্ষণ পরেই চারদিক গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়।
ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে জিপে ওঠার পর প্রথম দিকে কথা বলছিলেন সুকুমার পাল। হঠাৎ তিনি চুপ করে গেছেন।
সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে জিপের দুটো হেডলাইট জেলে দিয়েছিলেন সুকুমার। স্পিডও কমিয়ে দিয়েছেন। হেডলাইটের আলোয় উইন্ডস্ক্রিনের বাইরে চোখ রেখে তিনি গাড়ি চালাচ্ছেন।
আমরা এমন একটা জায়গায় চলে এসেছি যেখানে পাহাড় কাটা বেশ কটা রাস্তা নানা দিকে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। অনেকটা গোলকধাঁধার মতো।
জিপের ভেতর একটা লম্বাটে বাল্ব জ্বলছিল। তার আলোয় লক্ষ করলাম সুকুমার পালের চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।
জিপের স্পিড দ্রুত কমে আসছে। একসময় অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বললেন, ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো?
বলে কী লোকটা? আমি তাঁর দিক থেকে চোখ সরাইনি। জিগ্যেস করলাম, ভুল রাস্তায় চলে এসেছেন নাকি?
খানিকটা সামলে নিতে চাইলেন সুকুমার।-না, না, ভুল হয়নি।
তাঁর কথাগুলো খুব জোরালো মনে হল না। যেন আমাকে ভরসা দেবার জন্যে বলা।
সুকুমার ফের বললেন, কতবার গাড়ি ড্রাইভ করে জেফ্রি পয়েন্টে গেছি। ভুল হবে কেন? আপনিই বলুন
তিনি ভুল পথে যাচ্ছেন, না ঠিক পথে, সেটা আমি বলব! মাত্র দুদিন আগে এই প্রথম আন্দামানে এসে পোর্টব্লেয়ারে কাটিয়ে দিয়েছি। বিশ্বজিৎ রাহা এ কার সঙ্গে আমাকে জেফ্রি পয়েন্টে পাঠিয়েছেন। অবাক হয়ে সুকুমার পালের দিকে তাকিয়ে থাকি।
আরও খানিকটা চলার পর সুকুমার বললেন, মনে হচ্ছে ডান দিকের রাস্তাটায় গেলে জেফ্রি পয়েন্টে যাওয়া যাবে না; বাঁ দিকের রাস্তাটাই ধরা যাক, কী বলেন?
একেবারে থ হয়ে যাই। এই দ্বীপে আমার মতো আনকোরা একজনকে সুকুমার পাল কি পথপ্রদর্শকের দায়িত্বটা দিলেন। উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকি। এ ছাড়া আমার আর করারই বা কী আছে!
রাত আরও বাড়ছে, অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। আকাশে ফ্যাকাশে চাঁদ দেখা দিল, তার নির্জীব আলো দক্ষিণ আন্দামানের এই নিঝুম এলাকাটাকে কেমন যেন রহস্যময়, এবং ভীতিকর করে তুলেছে। চারপাশে আবছা আবছা পাহাড়গুলিকে দেখতে দেখতে মনে হয় প্রাগৈতিহাসিক বিশাল বিশাল আদিম সব প্রাণী যেন ওত পেতে আছে।
আমি মুখ বুজে বসেই আছি। গাইড হিসেবে আমাকে খুব সম্ভব পছন্দ হল না সুকুমার পালের। একটু বেপরোয়া হয়ে তিনি পাকদণ্ডি বেয়ে জিপটাকে পাহাড়ের মাথায় তুলছেন, তৎক্ষণাৎ নামিয়ে আনছেন। ডাইনে বাঁ-য়ে, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে জিপটাকে দৌড় করালেন। এইভাবে অনেকটা সময় কেটে গেল। তা কম করে ঘণ্টা দেড় দুই।
একসময় রীতিমতো ক্লান্ত এবং হতাশই হয়ে পড়লেন সুকুমার পাল। বললেন, ব্যাপারটা কী হল বলুন তো? কখন জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে যাবার কথা। আর আমরা কিনা, পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরপাক খেয়ে বেড়াচ্ছি।
আমারও খুব ক্লান্তি লাগছিল। বললাম, শেষ পর্যন্ত আজ রাত্তিরে জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছোতে পারব তো?
আমার কথায় খুব সম্ভব একটু খোঁচা ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে স্থির দৃষ্টিতে আমাকে কয়েক সেকেন্ড লক্ষ করে সুকুমার পাল কণ্ঠস্বরে বেশ জোর দিয়ে বললেন, আলবত পারবেন। আমি আছি না?
বলতে যাচ্ছিলাম, আপনি তো কয়েক ঘণ্টা ধরেই আছেন। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ মাইল যেতে চার পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে নাকি? কিন্তু বলা হল না।
এখন গাড়িটা একটা পাহাড়ের মাথা থেকে অনেকটা নেমে এসেছে।
হঠাৎ সুকুমার বললেন, দেখুন তো বাঁ দিকে একটু আলো দেখা যাচ্ছে না? ওই যে তিনি আঙুল বাড়িয়ে দিলেন।
ওঁর আঙুল বরাবর বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকি। কিন্তু কোথায় আলো? সুকুমার পালের মতো দিব্যদৃষ্টি আমার নেই। বললাম, কই, কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না।
সুকুমার পাল মানুষটি ভদ্র, বিনয়ী, খুবই শান্তশিষ্ট। কিন্তু এখন বেশ চটে উঠলেন।রায়বাবু, কলকাতায় ফিরে গিয়ে চোখ দেখাবেন। ওখানে নিশ্চয়ই আলো আছে। তার মানে মানুষজনও রয়েছে। ওদের জিগ্যেস করলে জেফ্রি পয়েন্টের রাস্তা দেখিয়ে দেবে, কী বলেন?
তিনি আমার জবাবের অপেক্ষা না করে বেশ জোরেই জিপটা চালিয়ে দিলেন। কিন্তু আলোর চিহ্নমাত্র চোখে পড়ল না। হতাশা তখন সুকুমার পালের ওপর চেপে বসেছে। বললেন, এই আলো দেখলাম। এখন আর দেখছি না। তা হলে কি আমার চোখটাই গেছে?
এ প্রশ্নের জবাব হয় না। আমি মুখ বুজেই থাকি।
আরও কিছুক্ষণ এলোপাতাড়ি জিপটাকে ছোটানোর পর আচমকা একটা অঘটন ঘটে গেল। বোমা ফাটার মতো প্রচণ্ড আওয়াজ করে জিপের একটা চাকা ফেঁসে গেল। ফস ফস করে হাওয়া বেরিয়ে চাকাটা চুপসে গিয়ে খানিকটা এগিয়ে থেমে গেল। জিপটাও খানিকটা কাত হয়ে গেছে।