তা হয়েছে। আমি মাথা কাত করি।
হালকা সুরে বিশ্বজিৎ বললেন, তার মানে হাড়গোড় সব আলগা হয়ে গেছে, কী বলেন?
উত্তর না দিয়ে আমি একটু হাসি।
বিশ্বজিৎ বললেন, এক উইক ভালো করে রেস্ট নিয়ে গায়ের ব্যথা কমান। তারপর যে জন্যে আসা
তাঁকে শেষ করতে দিলাম না—-না না না, আজ আর কাল, এই দুটো দিন বিশ্রাম করলেই চাঙ্গা হয়ে যাব।
ঠিক আছে। আগে পেনাল কলোনিতে যাবেন, না উদ্বাস্তু কলোনিতে?
উদ্বাস্তু কলোনি।
একটু ভেবে বিশ্বজিৎ বললেন, দেখুন, এই দক্ষিণ আন্দামানে অনেক জায়গায় পুনর্বাসনের কাজ শেষ হয়ে এসেছে। জেফ্রি পয়েন্টে সবে শুরু হয়েছে। হাজারখানেক উদ্বাস্তুকে সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছি। কীভাবে কলোনি বসানোর কাজ হয়, শুরু থেকে দেখলে আপনার পরিষ্কার একটা আইডিয়া হয়ে যাবে। আমার মনে হয় যে কারণে আপনার আসা, প্রথমে ওখানে যাওয়াটাই ঠিক হবে।
জেফ্রি পয়েন্টটা কোথায়?
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ মাইল সাউথ-ওয়েস্টে। একেবারে বে অফ বেঙ্গলের ধারে। একদিকে সমুদ্র, আর তিন দিকে পাহাড় আর ডিপ ফরেস্ট। এই ফরেস্টে কারা থাকে জানেন?
কারা?
জারোয়াদের নাম শুনেছেন?
শুনেছি। ওরা তো ভীষণ হিংস্র নিগ্রোয়েড একটা টাইপ।
ঠিক শুনেছেন। সভ্য জগৎ থেকে কেউ ওদের ধারে-কাছে যাক, সেটা ওরা একেবারেই চায় না। এর মধ্যে তির-ধনুক দিয়ে দু-তিনবার উদ্বাস্তুদের ওপর হামলা করেছে। ভেবে দেখুন, যাবেন? রিস্ক কিন্তু আছে।
অ্যাডভেঞ্চারের নামে চিরকালই আমার শিরায় শিরায় রক্ত নেচে ওঠে! আন্দামানে আসার বছর দুই আগে আমি উত্তর-পূর্ব ভারতের নাগা হিলসে গিয়েছিলাম। সেখানে জীবনের ঝুঁকি কম ছিল না। চার পাঁচ বার অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে এসেছি। বললাম, রিস্ক নিতে ভয় পাই না। লাইফে অনেকবার বিপদের মুখে পড়েও দিব্যি বেঁচে বর্তে আছি। এ নিয়ে ভাববেন না।
বিশ্বজিৎ রাহা খুব সম্ভব খুশিই হলেন।–ঠিক আছে। তবে ওখানে গিয়ে সাবধানে থাকবেন।
একটু চুপচাপ।
তারপর বিশ্বজিৎ বললেন, দু-দিন পর আমার সহকর্মী সুকুমার পাল জেফ্রি পয়েন্টে যাবেন। উনি উদ্বাস্তু পুনর্বাসন ডিপার্টমেন্টের একজন বড় অফিসার। চমৎকার মানুষ। পালবাবুকে আজই বলে রাখব। তিনি আপনাকে জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে যাবেন। ওখানে মাস দেড় দুই থাকলে আপনার ভালো রকম অভিজ্ঞতা হবে।
.
দিন দুই পর বিকেলবেলায় সুকুমার পাল চলে এলেন। আমি স্যুটকেস হোল্ড-অল গুছিয়ে তৈরি হয়ে ছিলাম। বিশ্বজিৎ রাহা আজ কোর্ট বা তাঁর পুনর্বাসন দপ্তরের অফিসে যাননি। আমি জেফ্রি পয়েন্টে যাব, তাই বাংলোতেই থেকে গেছেন। সুকুমার পালের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
সুকুমারের বয়স চল্লিশ একচল্লিশ। চোখেমুখে ভালোমানুষ ভালোমানুষ ভাব। চেহারাটা ভারী গোছের। সাজগোজের দিকে নজর নেই। পরনে ঢোলা ফুল প্যান্টের ওপর ফুল শার্ট, যেটার দুটো বোতাম নেই। পায়ে চামড়ার ফিতে বাঁধা চপ্পল।
জানা গেল, তাঁদের দেশ ছিল পূর্ব বাংলার ফরিদপুর জেলায়। দেশভাগের পর কলকাতায় এসে অন্য সব উদ্বাস্তুর মতো খুব কষ্টে কয়েকটা বছর কেটেছে। সুকুমারদের সংসারটা খুব ছোট নয়। বাবা, মা, সুকুমার এবং ছোট আরও তিন ভাইবোন।
দেশে থাকতে আই এটা পাশ করেছিলেন। তার জোরে এপারে এসে একটা ছোটখাটো কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন। দিনের বেলা চাকরি, রাত্তিরে নাইট ক্লাস করে বি-এ পাশ করার পর পুনর্বাসন বিভাগের এই চাকরিটা পেয়ে আন্দামানে চলে এসেছেন। ফ্যামিলির বাকি সবাই কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থাকে। ভাইবোনেরা কলেজে পড়ছে। সংসারের সব দায় সুকুমারের। প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, সরল মানুষটির সঙ্গে আলাপ করে খুব ভালো লাগল।
যাই হোক, জেফ্রি পয়েন্টে যাওয়ার সোজা কোনও রাস্তা নেই। বিশ্বজিৎ রাহা তাঁর গাড়িতে আমদের দুজনকে চ্যাথাম জেটিতে পৌঁছে দিলেন। সেখান থেকে লঞ্চে সমুদ্রের খাড়ি পেরিয়ে ওধারে বাম্বু ফ্ল্যাটের (?) জেটিতে চলে এলাম। জেটির বাইরে পুনর্বাসন বিভাগের একটা জিপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। যে ড্রাইভার গাড়িটা নিয়ে এসেছে তার নাম লতিফ। সে কিন্তু আমাদের জেফ্রি পয়েন্টে পৌঁছে দেবে না। রিহ্যাবিলিটেশন ডিপার্টমেন্টের একটা জরুরি কাজে যে লঞ্চটায় আমরা ব্যাম্বু ফ্ল্যাটে এসেছি সেটায় উঠে তাকে পোর্টব্লেয়ারে যেতে হবে। জিপটা চালিয়ে আমাকে নিয়ে জেফ্রি পয়েন্টে যাবেন সুকুমার পাল।
লতিফ গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বাঙালি মুসলমান। কাঁচুমাচু মুখে সুকুমারকে বলল, স্যার, পোর্টব্লেয়ারে আমাদের হেড অফিসে আজ আমাকে যেতেই হবে। নইলে আমি আপনাদের জেফ্রি পয়েন্টে নিয়ে যেতাম। গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে আপনার কষ্ট হবে।
সুকুমার বললেন, কীসের কষ্ট। আর দাঁড়িয়ে থেকো না। তিন-চার মিনিটের মধ্যে লঞ্চ চ্যাথামে চলে যাবে। যাও-যাও
লতিফ প্রায় দৌড়াতে দৌড়োতে জেটির দিকে চলে গেল।
সুকুমার পাল বললেন, উঠে পড়ুন
ফ্রন্ট সিটে আমরা পাশাপাশি বসলাম। সুকুমারের হাত স্টিয়ারিংয়ে। গাড়ি চলতে শুরু করল।
ব্যাম্বু ফ্ল্যাট জেটির প্রায় গা থেকেই পাহাড়ি রাস্তা। ক্রমশ সেটা চড়াইয়ের দিকে উঠে গেছে। দু-ধারে খাদ আর গভীর জঙ্গল। বিরাট বিরাট প্রাচীন সব গাছ যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ঝোপছাড়, মাথা সমান উঁচু বুনো ঘাসের জঙ্গল।