পশ্চিমবঙ্গ তো খুব বড় রাজ্য নয়। এখানে অসংখ্য উদ্বাস্তু কোথায় থাকবে? কী হবে তাদের ভবিষ্যৎ? তাই সরকারের উদ্যোগে আন্দামানে বনজঙ্গল নির্মূল করে উদ্বাস্তুদের চাষের জমি-টমি দিয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হল।
এই যে আমি হুট করে আন্দামানে চলে গেলাম তার একটি উদ্দেশ্য হল উদ্বাস্তুদের সঙ্গে থেকে স্বচক্ষে পুনর্বাসনের কাজ দেখা।
কিশোর পাঠকরা নিশ্চয়ই এতক্ষণে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। আশ্চর্য, ঘটনার লক্ষণই তো দেখা যাচ্ছে না। তাদের আরেকটু ধৈর্য ধরতে বলি। আন্দামানে যাওয়ার আমার আরও একটা উদ্দেশ্য ছিল।
সারা পৃথিবী দক্ষিণ আন্দামানের পোর্টব্লেয়ার শহরের কুখ্যাত সেলুলার জেলের কথা জানে। সেই ইংরেজ আমলে উনিশ শো পঁয়ত্রিশ সাল অবধি ব্রহ্মদেশ বা বার্মা (এখন মায়ানমার) ছিল অখণ্ড ভারতের একটি অংশ। বার্মা থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ পর্যন্ত এই বিশাল দেশের ভয়ংকর খুনিদের কালাপানির সাজা দিয়ে সেলুলার জেলে নিয়ে যাওয়া হত। এদের প্রায় সবাই যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আসামী। তখনকার আইনকানুন অনুযায়ী কালাপানিতে যাবজ্জীবন মানে আমৃত্যু আসামীদের আন্দামানেই কাটাতে হত। এই কয়েদিদের মধ্যে বাঙালি, বিহারি, ইউপিওয়ালা, শিখ, মারাঠি, পাঠান, জাঠ, তামিল, বর্মী, কারেন, এমনি সব রাজ্যের মানুষ ছিল।
অনেকেই জানেন না, সেলুলার জেলের মতো আরও একটা মস্ত জেনানা ফাটক ছিল পোর্টব্লেয়ারে। তার নাম সাউথ পয়েন্ট জেল। এই কয়েদখানা পুরোপুরি মেয়েদের জন্য। সেই আমলে বর্মা মুলুক থেকে সুদূর নর্থ ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স পর্যন্ত নানা প্রদেশে এমন অনেক মহীয়সী মহিলা ছিল যারা দায়ের কোপে দু-তিনজনের ধড় থেকে মুন্ডু নামিয়ে দ্বীপান্তরী সাজা নিয়ে সাউথ পয়েন্ট জেলে এসে উঠত। পুরুষ কয়েদিদের মতো এই মেয়েদেরও দেশে ফিরে যাবার উপায় ছিল না।
ইংরেজ সরকার এক দিক থেকে বেশ সদাশয়ই ছিল বলা যায়। কোনও পুরুষ কয়েদি যদি আন্দামানে এসে দুবছর আর মেয়ে কয়েদি এক বছর শান্তশিষ্ট হয়ে থাকত, তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করা হত। জাতিগোত্র ঠিকুজি কুলুজি মিলিয়ে বিয়ে নয়। একজন বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বর্মী বা কারেনের সঙ্গে বাঙালি হিন্দুর, জাঠের সঙ্গে তামিলের, পাঠানের সঙ্গে শিখের–এইভাবে বিয়ে হত। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ, কোনওরকম বাছবিচার ছিল না।
বিয়ের পর এই কয়েদিদের আর জেলখানায় থাকতে হত না। সরকার থেকে পোর্টব্লেয়ার এবং আশপাশের নানা দ্বীপে তাদের থাকার জন্য কাঠের ছোট ছোট অনেক বাড়ি আর নানা ধরনের কাজকর্মের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এই সব বাড়ি এবং তার বাসিন্দাদের নিয়েই গড়ে উঠেছিল অগুনতি পেনাল কলোনি।
আমার দুনম্বর উদ্দেশ্য ছিল, এই পেনাল কলোনিগুলোতে দু-তিন মাস কাটিয়ে পুরোনো কয়েদিরা দেশের স্বাধীনতার পর কীভাবে দিন কাটাচ্ছে তা জানা।
ভূমিকা এখানেই শেষ। এবার ধীরে ধীরে সেই আশ্চর্য ঘটনার কথায় আসা যাক।
স্টিমশিপ মহারাজার কথা আগেই জানিয়েছি। দশ বারো হাজার টনের সেই জল্যানটিতে টানা তিন দিন তিন রাত কাটিয়ে চতুর্থ দিন সকালে পোর্টব্লেয়ারের চ্যাথাম জেটিতে গিয়ে নামলাম।
আমার বন্ধু বিশ্বজিৎ রাহা (নাম পরিবর্তিত) ছিলেন আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের ফার্স্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেট এবং আন্দামানের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিভাগের একজন জাঁদরেল অফিসার। তখনও পর্যন্ত অবিবাহিত এই মানুষটির ধ্যানজ্ঞান ছিল বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য চাযের জমি, বাড়িঘর এবং রোজগারের নিখুঁত বন্দোবস্ত করে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জকে দ্বিতীয় বঙ্গভূমি গড়ে তোলা। এজন্য বেছে বেছে কয়েকটি টিম তৈরি করেছিলেন। এই অফিসারদের প্রচণ্ড উদ্যম, প্রচুর কর্মক্ষমতা। যেখানে যেখানে উদ্বাস্তু কলোনির কাজ চলছে সেই সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে তাঁরা কাজকর্ম তদারক করতেন। এসব খবর আমি কলকাতায় বসেই শুনেছিলাম।
বিশ্বজিৎ একটা জিপ হকিয়ে আমাকে নিয়ে যাবার জন্য চ্যাথাম জেটিতে এসেছিলেন। সঙ্গে তাঁর আর্দালি।
জাহাজ থেকে নেমে আসতেই অন্য প্যাসেঞ্জারদের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। বিশ্বজিৎ হাসিমুখে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললেন, ওয়েলকাম টু আন্দামান আইল্যান্ডস। চলুন—
আমি হাসলাম।
জেটির বাইরে কার পার্কিং এরিয়া। বিশ্বজিৎ আমাকে নিয়ে একটা নীল অ্যামবাসাডরের ফ্রন্ট সিটে উঠলেন। আমার স্যুটকেস-টুটকেস নিয়ে ব্যাকসিটে উঠল তাঁর আর্দালি হরিপদ।
শো ফার ছিল না। বিশ্বজিৎ নিজে ড্রাইভ করে গাড়িটাকে চ্যাথাম পোর্টের বাইরে নিয়ে এলেন। তারপর সোজা এগিয়ে চললেন।
পোর্টব্লেয়ার পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাহাড়ি শহর। কাঠের বাড়িঘর বেশি। দালানকোঠা কম। ভিড়টিড় নেই বললেই হয়।
মাইল তিনেক দৌড়ের পর অ্যামবাসাডর সেলুলার জেলের কাছাকাছি সমুদ্রের ধারে একটা মস্ত কাঠের বাংলোর সামনে এসে থামল। বিশ্বজিৎ বললেন, এই আমার আস্তানা। নেমে আসুন।
বাংলোয় ঢুকে একটা সাজানো গোছানো ড্রইংরুমে আমাকে বসিয়ে বিশ্বজিৎ মুখোমুখি বসলেন। বেশ কয়েকজন কাজের লোককে দেখা গেল। তাদের একজনকে ডেকে বললেন, আমাদের চা-টা দে
শুধু চা-ই নয়, ঘরে তৈরি প্রচুর খাবার দাবারও এল। খেতে খেতে নানারকম কথাবার্তা চলল। বিশেষ করে কলকাতায় উদ্বাস্তুরা কী অবস্থায় আছে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরও কত মানুষ আসতে পারে, ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময় বিশ্বজিৎ বললেন, বে অফ বেঙ্গল খুবই বদমেজাজি সমুদ্র। আসার সময় নিশ্চয়ই রোলিং হয়েছে?