হাঁ হাঁ, জরুর। বোল বোল
তুমি যে এত টাকা ওড়াচ্ছ, কোথায় এসব পাও? কী কর?
চোখ সরু করে নিজের বুকে আঙুল ঠেকিয়ে মিটিমিটি হাসতে হাসতে যোহন বলল, আমি ফুল-টাইম ফোর টোয়েন্টি
বলে কী লোকটা! আমি চমকে উঠি। বললাম, মানে
মানে আবার কী। এর টুপি ওর মাথায়, ওর টুপি এর মাথায় চাপিয়ে কাম হাসিল করে নিই।
সবকিছু গুলিয়ে যায়। আমি আকাশ পাতাল হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।
মিটি মিটি মিচকে হাসিটি তার মুখে লেগেই আছে। বলল, বম্বেতে কত লোক আছে? এখানকার পপুলেশন কত?
আমার ভেতর তালগোল পাকিয়ে যায়। এই পিটা আমাকে সেনসাস ডিপার্টমেন্টের বড় কর্তা ভেবেছে নাকি? সেইসময় বম্বেতে এখনকার মতো জনবিস্ফোরণ ঘটেনি। আন্দাজে বললাম, ষাট লাখের মতো হবে।
বহুৎ আচ্ছা। এই ষাট লাখের ভেতর চাল্লিশ লাখ গাধা নেই?
মানে?
মানে আমার চেয়ে তাদের মগজের ধার কম। এই গাধূধেগুলোকে পথে বসিয়ে টাকা পয়সা আর মাল খালাস করি। সমঝা?
ব্যাপারটা এতক্ষণে বোধগম্য হল। বললাম, তুমি এত এত জিনিস আর টাকা নিয়ে এসে সবাইকে বিলিয়ে দাও। নিজের জন্যে কিছু রাখো না কেন?
দুহাতের আঙুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে যোহন বলল, নো সেভিংস বিজনেস স্যার। আজ এক গাধধেকে টুপি পরিয়ে যা আমদানি হবে, আজই তা খতম করব। কাল নয়া গাধূধে পাকড়াব। এইভাবে চালিয়ে যাচ্ছি।
যোহনের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর একটা ব্যাপার লক্ষ করেছি মর্নিং ওয়াকের পর টি স্টলে এসে বেশ কিছুক্ষণ চুটিয়ে মজাদার কাণ্ড-টান্ড করে ভিড় হালকা হলে বিচের ছেলেদের নিয়ে উত্তর দিকে চলে যায়। আপেল, শার্ট বা অন্য কোনও জিনিস আনলেও তার কাঁধে থাকে একটা কাপড়ের ভারী ব্যাগ। সেটা কখনও সে সবার সামনে খোলে না। ব্যাগটা কোন জাদুগা ঝাপ্পি, কে জানে।
একদিন মর্নিং ওয়াকের পর আমার সঙ্গীরা প্রায় সবাই চলে গেছে। কারণ সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকলেই তো চলবে না। সবারই চাকরি-বাকরি বা ব্যাবসা- ট্যাবসা আছে। বিচ থেকে ফিরে কাজের জায়গায় তত তাদের দৌড়তে হবে।
আমিও জুহু থেকে কুড়ি-বাইশ মাইল দূরে ফোর্ট এরিয়ায় নামকরা একটা অ্যাড কোম্পানিতে ছোটখাটো কাজ করি। ফোর্ট এরিয়া হল কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার বা বিবাদিবাগের মতো বিশাল অফিসপাড়া। সেদিন ঠিক করলাম অফিসে যাব না। বিচের ছেলেদের নিয়ে অনেকটা দূরে চলে গেছে। আমি তাদের পিছু নিলাম।
চায়ের স্টল, ভেলপুরি-টুরির স্টলুগলো থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে সান অ্যান্ড স্যান্ড হোটেলের পেছন দিকটায় অজস্র নারকেল গাছের জটলা। চোখে পড়ল ছেলেগুলোকে নিয়ে যোহন তার ভেতর ঢুকে বসে পড়ল, নারকেল গাছগুলোর গা ঘেঁষে একটা পুরোনো জং ধরা টিনের চালের ঘর।
ছেলেরা ঘর থেকে বই-টই নিয়ে যোহনের সামনে বসল। যোহনের কাঁধে যে ভারী ব্যাগটা ছিল যেটা নামিয়ে রেখেছিল। ব্যাগ থেকে প্রচুর খাতা পেন্সিল বের করে ছেলেগুলোকে দিতে দিতে বলল, নে, এবার শুরু কর–
আমি খানিক দূরে একটা ডালপালাওয়ালা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের লক্ষ করছি।
খুব মগ্ন হয়ে পড়াচ্ছে যোহন। পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মাঝে বলছে, বিচে যারা বেড়াতে আসে তাদের খিদমত করে দুচারটে টাকা বকশিস পেয়ে তামাম জিন্দেগি কি কেটে যাবে। বোম্বাইতে হাজারো নয়া কল-কারখানা বসছে। পেটের ভেতর থোড়েসে এডুকেশন ঘুষিয়ে নে। কোথাও না কোথাও নৌকরি জুটে যাবে। বুঝলি কিছু?
আমি অবাক। এই যোহন আমার পুরোপুরি অচেনা। সে কি ফেরেববাজ, প্রতারক, নাকি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, সমাজসেবী না দার্শনিক?
একসময় প্রায় সারা ভারতবর্ষ আমি ঘুরে বেড়িয়েছি কিন্তু যোহনের মতো পরমাশ্চর্য মানুষ আর একটিও দেখিনি।
গল্প নয় ২
শুরুতেই কবুল করি এটি বানানো গল্প নয়; আমার জীবনের আশ্চর্য একটি ঘটনা। ঘটনাটি ঠিক কেমন, কোথায় কীভাবে ঘটেছিল তা বলার আগে ছোটখাটো একটি ভূমিকা করে নেওয়া যাক। নইলে পড়তে পড়তে খাপছাড়া মনে হবে।
সাতান্ন কি আটান্ন বছর আগে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে আমি আন্দামানে যাই। যে জাহাজটিতে গিয়েছিলাম তার নাম এস এস মহারাজা। এস এস হল স্টিমশিপ। তখনকার দিনে বেশির ভাগ জাহাজই কয়লা জ্বালিয়ে বাষ্প তৈরি করে তার জোরে চালানো হত।
কিশোর ভারতী পত্রিকার কিশোর পাঠকরা জানে আন্দামান একটি মাত্র দ্বীপ নয়। আড়াই শোরও বেশি ছোটবড় দ্বীপ মিলিয়ে বিশাল এই আর্কিপেলাগো বা দ্বীপপুঞ্জ। অজস্র এই দ্বীপগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় হল তিনটি দ্বীপ–দক্ষিণ আন্দামান, মধ্য আন্দামান আর উত্তর আন্দামান। এগুলোর প্রতিটি চল্লিশ বেয়াল্লিশ মাইল লম্বা, প্রস্থ কম করে তিরিশ বত্রিশ মাইল। আন্দামানের সমস্ত দ্বীপ জুড়ে শুধু পাহাড় আর গভীর জঙ্গল। তবে পাহাড়গুলো খুব উঁচু নয়; বড় জোর সাড়ে তিন কি চার হাজার ফিট উঁচু।
এই পত্রিকার পাঠকরা আরও জানে উনিশশো সাতচল্লিশের পনেরোই অগস্ট ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল আর সেই একই তারিখে অখণ্ড ভারত টুকরো হয়ে আলাদা আলাদা দুটো দেশের সৃষ্টি হল–পাকিস্তান এবং বাকি অংশটার নাম ভারতই থেকে গেল। ভারতের পশ্চিম দিকে পাকিস্তানের একটা অংশ পড়ল; তার নাম পশ্চিম পাকিস্তান আর পুব দিকে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা ঘেঁষে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে যার নাম বাংলাদেশ)। পূর্ব পাকিস্তানে সেই সময় এমনই ভয়ংকর দমবন্ধ-করা পরিস্থিতি যে বাঙালি হিন্দুদের পক্ষে সেখানে থাকা আর সম্ভব ছিল না। লক্ষ লক্ষ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে সীমান্তের এপারে পশ্চিমবাংলায় চলে এল। তাদের একটা তকমা দেওয়া হল উদ্বাস্তু। নরম করে বলা হত শরণার্থী।