বিচের আরেক দিকে সারি সারি স্টল। কোনওটা নিম্বুচায়ের (লেবু চা), কোনওটা আইসক্রিমের, কোনওটা ভেলপুরি, বাটাটা পুরির, কোনওটা ইডলি দোসার, কোনওটা নারিয়েল পানির।
দেখতে দেখতে রোদ উঠে যায়, বেলা চড়তে থাকে।
ঘণ্টা দেড়েক ঘাম ঝরিয়ে হাত-পা ছোঁড়া, ফুসফুসে তরতাজা সামুদ্রিক বাতাস টানা, তারপর স্বাস্থ্যান্বেষীরা বেশিরভাগই চলে যায় স্টলগুলোর দিকে। অন্য অনেকের সঙ্গে আমি যাই নিষু চায় অর্থাৎ লেবু-চায়ের স্টলে। বাকি সবাই অন্য স্টলগুলোতে। চার কুইন্ট্যাল ওজনের কয়েক জন সিন্ধি আর গুজরাতি মহিলাকে রোজই দেখি দৌড় ঝাপের পর আইসক্রিমের স্টলে ভিড় জমান। বিচে এক দেড় ঘণ্টা যে পরিমাণ মেদ ঝরান আইসক্রিম পার্লার থেকে তার পাঁচ-সাত গুণ ক্যালোরি সংগ্রহ করে বাড়ি ফেরেন।
প্রাতভ্রমণে এসে অনেকের সঙ্গেই আলাপ পরিচয় হয়েছে। বন্ধুত্বও আমাদের সেই দলটা চায়ের স্টলে এসে লেবু-চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিছুক্ষণ আড্ডা-টাজ্ঞা দিয়ে যে যার আস্তানায় ফিরে যাই।
এইভাবেই চলছিল।
একদিন সমুদ্রসৈকতে হেঁটে এসে চায়ের স্টলে সবে আমরা জড়ো হয়েছি, পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছরের একটি লোক হই হই করতে করতে এসে হাজির, আ গিয়া রে, ম্যায় আ গিয়া
আমি না চিনলেও আমার সঙ্গীরা তাকে ভালোই চেনে। তারা শোরগোল বাধিয়ে দিল।–কোথায় ছিলে এতদিন?
লোকটা বলল, ইন্ডিয়াটা তো ভালো করে দেখা হয়নি। তাই একটু ঘুরে-টুরে এলাম– বলেই চায়ের স্টলওয়ালার দিকে তাকাল, সবাইকে চায় আউর বিস্কুট, কেক-টেক দাও! কারও কাছ থেকে পাইসা নেবে না। বিল আমি মেটাব।
স্টলের অল্পবয়সি কাজের ছেলেরা পুরু কাগজের কাপ প্লেটে চা, কেক বিস্কুট সাজিয়ে সবার হাতে হাতে দিতে লাগল।
একটা অচেনা লোক যাকে আগে কখনও দেখিনি, সে আমাকে চা-টা খাওয়াতে চাইছে, ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিল। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ তার নজর এসে পড়ল আমার দিকে, তোমার সঙ্গে আগে তো মোলাকাত হয়নি। মনে হচ্ছে নয়া আমদানি। কোত্থেকে এসেছ, কী নাম?
নাম ধাম জানিয়ে দিলাম।
লোকটা বলল, বংগালি। বহুৎ আচ্ছা। আমার নাম যোহন–যোহন ডিসুজা। পি হো-পি
নাম শুনেই বুঝলাম লোকটা গোয়ান ক্রিশ্চান। বম্বেতে এদের বলে পিদ্রু।
যোহন তাড়া দিতে লাগল, চায় লে লো; মুঝে আপকা দোস্ত সমঝো
আমার ভ্রমণসঙ্গীরাও তার সঙ্গে গলা মেলায়, নিয়ে নাও, নিয়ে নাও। না নিলে যোহন ছাড়বে না।
অগত্যা নিতেই হল।
ওদিকে বিচ-বয়রা অর্থাৎ যে ছেলেগুলো জুহুর সমুদ্র সৈকতে বারো মাস, দিন রাত পড়ে থাকে, যোহনকে দেখে চারিদিক থেকে উধ্বশ্বাসে দৌড়তে দৌড়তে এসে তাকে ছেকে ধরল, তারপর চেঁচামেচি জুড়ে দিল, চাচা, কতদিন তোমাকে দেখিনি, ভাবলাম আমাদের ছেড়ে তুমি চলেই গেছ। আর কখনও ফিরে আসবে না।
এর ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলোতে যোহন বলল, আরে উল্লুরা, তোদের ছেড়ে বরাবরের জন্যে চলে যাব, ভাবলি কী করে? এই তো চলে এসেছি। পকেট থেকে এক তাড়া নোট বের করে ছেলেগুলোকে দিল, এই নে, ভেলপুরি, বাটাটা পুরি, যা দিল চায়, খেয়ে নে। কিছুক্ষণ পর তোদর নিয়ে সেই জায়গাটায় যাব–
এতগুলো কড়কড়ে নোট পেয়ে ছেলেগুলো আহ্লাদে আটখানার জায়গায় আঠারো খানা। তারা লাফাতে লাফাতে খাবারের স্টলগুলোর দিকে চলে গেল।
যোহন আবার আমাদের সঙ্গে আড্ডায় জমে গেল। একজন বলল, তুমি ছিলে না। হাসি নেই, মাজাক নেই। মনে হত জুহু বিচের জানটাই চলে গেছে।
ভুরু নাচাতে নাচাতে যোহন বলল, এই তো জান ফিরে এসেছে।
আরও কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে বিচ-বয়গুলোকে ডেকে নিয়ে উত্তর দিকে চলে গেল যোহন।
.
এরপর রোজই সকালে বিচে আসতে লাগল যোহন। মজার মজার কথায় সবাইকে মাতিয়ে দিয়ে ঘণ্টাখানেক পর বিচ-বয়গুলোকে সঙ্গে করে উত্তর দিকে চলে যায়। সেখানে ওরা কী করে, প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি।
একদিন যোহন মস্ত এক ঝুড়ি আপেল নিয়ে এল। কম করে শদেড়েক তো হবেই। সবাইকে একটা একটা করে দিতে দিতে বলল, সাচ্চা কাশ্মীরি আপেল। বহুৎ বড়িয়া খাও খাও
আমিও একটা পেয়ে গেলাম। না নিয়ে উপায়ও নেই, যোহন কিছুতেই ছাড়বে না। কিন্তু মনে একটা ধন্দ থেকে গেল। এত আপেল সে কোথায় পেল? কিনে এনেছে কি? এক ঝুড়ি আপেলের দাম তো কম নয়। গাঁটের পয়সা খরচ করে লোককে খাওয়ানোর কারণ কী হতে পারে? মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।
আরেকদিন সে নিয়ে এল এক পেটি নতুন টি-শার্ট। তাও কমসে কম শখানেক হবে। সেই একই কায়দায় একটা একটা করে সবাইকে বিলিয়ে দিল। আমাকে অবশ্য গছাতে পারেনি।
এইভাবেই মাঝে মাঝে দামি দামি নানা জিনিস এনে হাজির করে বিলিয়ে দিতে লাগল সে। জুহু বিচের নতুন বন্ধুদের জিগ্যেস করে জানা গেল, এমনটাই নাকি যোহন অনেকদিন ধরে করে আসছে।
অন্য একদিন সে একেবারে তাক লাগিয়ে দিল। একটা অ্যাটাচি কেস বোঝাই কড়কড়ে একশো টাকার অগুনতি বান্ডিল এনো অকাতরে সবাইকে দুটো চারটে করে দিল।
টি-শার্টের মতোই আমাকে টাকা নেওয়াতে পারেনি যোহন। যত তাকে দেখছি ততই অবাক হচ্ছি। লোকটার বাড়িতে কি টাকার গাছ গজিয়েছে? যখন ইচ্ছা হল পেড়ে এনে দেদার বিলিয়ে চলেছে।
অবাক যত হচ্ছিলাম, তার চেয়ে ঢের বেশি হচ্ছিল কৌতূহল। একদিন যোহনকে একা পেয়ে বললাম, তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।