কী, কী বললে!
যা বলেছি তা তো শুনেছই।
মুখ সামলে কথা বলবে।
একমুহূর্ত থমকে রইল শশাঙ্ক। পরক্ষণেই গর্জে উঠল, কেন তোর ভয়ে! সত্যি কথাটা বলতেই গায়ে বুঝি ফোঁসকা পড়ল। মনে করেছিস আমি কিছুই জানি না। তোর সঙ্গেই তো বিয়ে হবার কথা ছিল অনিমেষের। বিয়ের আগে।
.
শুনতে শুনতে শশাভনার মনে হল, একেবারে অন্ধ আর বধির হয়ে গেছে। ব্যাপারটা নিতান্তই তুচ্ছ। মঞ্জুর স্বামী অনিমেষ ছিল নদীয়া জেলায় তাদের সেই মফস্বল শহরেরই ছেলে। শোভনাদের বাড়িতে খুবই যাতায়াত ছিল। প্রচুর হাসতে পারত সে। মজা করতে, গল্প জমাতে বিশারদ ছিল। গানের গলাখানি চমৎকার। ভালো ফুটবল খেলতে পারত। তার ওপর ছিল প্রিয়দর্শন, সুপুরুষ। মফস্বল শহরের ছোট্ট পরিধির মধ্যে থাকত, বাড়িতে যাওয়া-আসা ছিল। স্বাভাবিক নিয়মেই শোভনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। মনেও রঙ লেগেছে। সেই রঙ গাঢ় হয়েছিল যখন তার সঙ্গে বিয়ের কথা উঠল। কথাটা অনেকদূর এগিয়েছিল। কিন্তু পাকাপাকি হবার পর্যায়ে এসে ভেঙে যায়। কেননা অনিমেষের বাবার দাবি পূরণ করা শোভনার বাবার পক্ষে অসাধ্য ছিল। এদিকে ছোটকাকা এমন একটি শিকার হাতছাড়া করলেন না। কন্ট্রাক্টরির দৌলতে তার প্রচুর টাকা। অতএব অনিমেষের সঙ্গে মঞ্জুর বিয়ে হয়ে গেল। আর শোভনার বাবা হন্যের মতো খুঁজে খুঁজে শশাঙ্ক নামে মার্চেন্ট অফিসের এক কেরানিকে আবিষ্কার করলেন। যাই হোক, বিয়ের পর চেতনে বা অবচেতনে প্রাক-বিবাহ সেই রঙের চিহ্নমাত্র ছিল না। নিজের দীন সংসার, ছেলেমেয়ে এবং শশাঙ্ককে নিয়েই পরিতৃপ্ত হতে চেয়েছিল শোভনা।
এদিকে শশাঙ্ক থামেনি। সামনে গজরাচ্ছে। কেন যে মঞ্জুদের ওখানে যাবার জন্য তোর প্রাণ আঁকুপাঁকু–সব জানি। কিন্তু তা হবে না। ছবছর যেতে দিইনি। কোনওদিন দেবও না। ভেবেছিস
শশাঙ্কর পিঙ্গল চোখ দুটি জ্বলছে। গলার কাছে শিরাগুলো দড়ির মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠেছে। সন্দিগ্ধ চতুষ্কোণ মুখটা কী নিষ্ঠুরই না হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে শশাঙ্ক যেন মানুষ না, একটা আদিম হিংস্র পশু।
শোভনার মনে হল, কোথাও যেতে হয় না। বিশ শতকের এই সভ্য সুসজ্জিত কলকাতাও মাঝে মাঝে অরণ্য হয়ে উঠতে পারে। সেই রাত্রেই মঞ্জুকে চিঠি লিখল শোভনা, মঞ্জু, বাঘ-ভালুক দেখার জন্যে আমাকে যেতে লিখেছিস। নতুন করে অতদূরে কী আর দেখতে যাব বল। দণ্ডকারণ্যের জন্য এতটুকু আকর্ষণ বোধ করছি না। এই কলকাতা শহরেই এক অরণ্যের মধ্যে বাস করছি ভাই।
গল্প নয় ১
প্রায় ষাট বছর হয়ে গেল, আমি তখন বম্বেতে। বম্বে সেই সময় মুম্বই হয়নি। থাকতাম জুহুতে। জুহু বিচের ভুবন জোড়া নাম।
আমার আস্তানা ছিল আদ্যিকালের একটা পার্শি কলোনিতে। টানা ব্যারাকের মতো লম্বা লম্বা কটা বিল্ডিং। সেগুলোর মাথায় সিমেন্ট দিয়ে সাঁটা টালির ছাদ। এই কলোনিরই দুটো কামরা ভাড়া নিয়ে থাকতাম।
জুহু তখন আজকের মতো এমন জমকালো ছিল না। এখন চারিদিকে সারি সারি হাই-রাইজের ছড়াছড়ি, কত যে পাঁচ-তারা সাত-তারা হোটেল। সেই সময় এলাকাটা ফাঁকা ফাঁকা। যেদিকেই তাকানো যাক অজস্র নারকেল গাছ। তবে গ্ল্যামার একটা ছিলই। হিন্দি ফিল্মি দুনিয়ার নায়ক-নায়িকাদের চোখ ধাঁধানো বাংলো ছিল বেশ কয়েকটা। একটা মাত্র পাঁচতারা হোটেল ছিল–সান অ্যান্ড স্যান্ড।
আমাদের পার্শি কলোনির পাশ দিয়েই চলে গেছে ঝা চকচকে জুহু-তারা রোড, রাস্তাটার গা ঘেঁষে নারকেল গাছের সারি। তারপরেই বিচ–সোনালি বালির সৈকত। দক্ষিণ দিক থেকে এসে উত্তরে বহুদূর চলে গেছে। বিচের পরেই আদিগন্ত আরব সাগর। আরব সাগর বে আব বেঙ্গলের মতো খামখেয়ালি, বদমেজাজি, খ্যাপাটে ধরনের নয়। বর্ষাকালটা বাদ দিলে সারাক্ষণ শান্ত।
বম্বে দেশের পশ্চিমপ্রান্তে। তাই কলকাতায় সূর্যোদয় যখন হয় পৌনে ছটা কি ছটায়, বম্বেতে সূর্য দর্শন দেন তার এক ঘন্টা পরে, ঘড়িতে সাতটা বাজিয়ে।
ভোর হতে না হতেই আমি বিচে চলে যাই। তখনও রোদের দেখা নেই, চারিদিক ঝাপসা ঝাপসা। আমি শুধু একাই নই, সমুদ্রের টাটকা বাতাস ফুসফুসে টানার জন্য কম করে শপাঁচেক নানা বয়সের মানুষ ততক্ষণে হাজির হয়ে গেছে। বেলা যত বাড়ে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে ভিড়। প্রাতভ্রমণকারীর দঙ্গল কখনও উত্তর থেকে দক্ষিণে, কখনও দক্ষিণ থেকে উত্তরে লম্বা লম্বা কদমে হাঁটতে শুরু করেছে। আমিও তো একই ঝুঁকের কই। একটা দলের সঙ্গে ভিড়ে যাই। তারপর হাত-পা ছুঁড়ে মার্চ করতে করতে জুহুর সোনালি সৈকত দাপিয়ে বেড়াই।
হাঁটাহাঁটি কিন্তু সবাই করে না। অনেকেই যোগাসনে বসে যায়। কেউ কেউ আবার মাথা নীচে রেখে পা দুটো সোজা ওপরে তুলে জ্যামিতির পিরপেন্ডিকুলারের মতো নট নড়নচনড়; ঘন্টাখানেক একদম স্থির হয়ে থাকে।
বিচের একধারে ঘোড়া আর উটওয়ালাদের ঘাঁটি। তাদের কাছ থেকে ঘোড়া কি উট ভাড়া দিয়ে অনেকে হই হই করে হর্স রাইড কি ক্যালে রাইডে বেরিয়ে পড়ে।
প্রাতভ্রমণকারীরা ছাড়া জুহু সৈকতে যাদের চোখে পড়ে তারা হল বারো- চোদ্দো বছরের কত যে বিচ-বয়। শীত-গ্রীষ্ম বারো মাস, দিন রাত তারা এখানেই থাকে। কারা তাদের বাপ-মা কেউ জানে না। প্রাতভ্রমণকারীদের ফরমাশ মতো এটা সেটা করে দিয়ে বকশিশটা ভালোই পায়। এটাই তাদের একমাত্র রোজগার।