যাই হোক, বি.এ পড়তে পড়তেই দুজনের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং তা-ও মাসখানেকের মধ্যেই। প্রথমে মঞ্জুর, পরে শোভনার। বিয়ের পর বোম্বাই চলে গিয়েছিল মঞ্জু। আর শোভনা এসেছিল কলকাতায়।
কলকাতা বললে ঠিক বোঝানো যায় না। এই শহরের পূর্ব মেরুতে এক জন্মান্ধ রুদ্ধশ্বাস গলির শেষ প্রান্তে জীর্ণ ধ্বংসপ্রায় একটা বাড়িতে তাকে এনে তুলেছিল শশাঙ্ক। সেখানে এজমালি একখানা উঠোন ঘিরে বৃত্তাকারে সারিবদ্ধ ঘর। সেই ঘরগুলির একটিতে শশাঙ্কর সংসার।
কলকাতার এই অংশের এই বাড়িটিতে শীত-গ্রীষ্ম কোনও ঋতুই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না। সবসময় যেন ছায়া-ছায়া বিষণ্ণ বিকেল। সূর্য বিষুবরেখায় না গেলে এ বাড়িতে রোদ আসে না।
শোভনার বিয়ে হয়েছে ছবছর। ছবছর, অর্থাৎ একটা যুগের অর্ধেক। এর ভেতর বার দুই নদীয়ায় যাওয়া ছাড়া সময়ের এই বিরাট অংশটা আলো-বাতাস-বর্জিত রুদ্ধ গলিতেই কেটে গেল। এর মধ্যে সংসার বেড়েছে। দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে হয়েছে।
চিঠিটা হাতের মুঠোতেই ছিল। হঠাৎ সমস্ত স্নায়ুতে কেমন এক অস্থিরতা অনুভব করল শোভনা। ছটা বছর পূর্ব কলকাতার এই বিবরে আবদ্ধ হয়ে আছে সে। অথচ-অথচ বিয়ের আগে আশ্চর্য যাযাবর একখানা মন ছিল তার। হিল্লি-দিল্লি, কাশী-কাঞ্চী—ভারতবর্ষের দুর দিগন্তগুলি দুর্বার আকর্ষণে তাকে টানতে থাকত। বিশেষ করে অরণ্যের প্রতি তার মোহ ছিল তীব্র। কিন্তু বেড়াতে নিয়ে যাবার মতো সঙ্গতি তার বাবার ছিল না। কাজেই মনসা-মথুরাং আর ভ্রমণকাহিনি পড়েই শব্দ মেটাতে হত। মনে মনে নিরুচ্চার একটা স্বপ্ন ছিল, তেমন কারো হাতে গিয়ে যদি পড়ে, বিয়ের পর সব সাধ মিটিয়ে নেবে। তেমন বিয়ে তো প্রায় স্থিরই হয়ে গিয়েছিল। সেটা হলে আজ মঞ্জুর বদলে সে-ই তো–কিন্তু–চিঠিটা হাতে নিয়ে আত্মবিস্মৃতের মতো কতক্ষণ বসে ছিল খেয়াল নেই। হঠাৎ ছোট ছেলেটা তক্তপোষের ওপর ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল। ঘোর কেটে গেল শোভনার। ইতিমধ্যে বিকেলটা কখন যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। পূর্ব কলকাতার জন্মান্ধ গলির পটে সন্ধে নামতে শুরু করেছে।
.
সন্ধের পর শশাঙ্ক অফিস থেকে ফিরে এল। চা-খাবার খাওয়া হলে বিকেলের সেই চিঠিখানা তার হাতে দিল শোভনা।
শশাঙ্কর মুখটা চতুষ্কোণ, চোখ দুটি পিঙ্গল। দৃষ্টিতে কোনও ভাবের খেলাই খেলে না। তার দিকে তাকালে স্নায়ুতে ধাক্কা লাগে যেন। মনে হয় এই লোকটির অদৃশ্য গভীরে কোথায় যেন খানিকটা নিষ্ঠুরতা রয়েছে। যাই হোক নিরুৎসুক সুরে শশাঙ্ক বলল, কী ব্যাপার, কার চিঠি?
শোভনা বলল, পড়েই দেখো না।
পড়তে পড়তে শশাঙ্কের পিঙ্গল চোখে কীসের একটা ছায়া পড়ল যেন। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই। দ্রুত পড়া শেষ করে এক সময় নিস্পৃহ ভাববর্জিত মুখে চিঠিটা শোভনার হাতে ফিরিয়ে দিল সে।
সাগ্রহে শোভনা বলল, পড়লে?
হুঁ। শশাঙ্কের গলা থেকে সংক্ষিপ্ত একটা শব্দ বেরিয়ে এল।
তা হলে মঞ্জুকে কী লিখব?
এত তাড়াহুড়োর কী আছে। বলতে বলতে শশাঙ্ক উঠল, যাই, আজকের বাজারটা সেরে রাখি। কাল একটু তাড়াতাড়ি বেরুতে হবে। সকালে সময় পাব না।
.
দণ্ডকারণ্য তার সমস্ত অস্তিত্বের মধ্যে তরঙ্গ তুলেছে। কাল শশাঙ্ক বলেছিল ব্যস্ততার কিছু নেই। কিন্তু পরের দিনই আবার সেই প্রশ্নটা তুলল শোভনা, কটা দিন ছুটি নিয়ে চলো না, মঞ্জুদের ওখানে বেড়িয়ে আসি?
ইয়ার এন্ডিং হয়ে আসছে। দুমাসের মধ্যে এখন অফিস থেকে ছুটি পাওয়া যাবে না।
বেশ তো, ইয়ার এন্ডিং-এর পরই না হয় যাওয়া যাবে?
দেখি।
দুটো মাস আশায় আশায় রইল শোভনা। ইতিমধ্যে আরো তিনখানা চিঠি এসেছে মঞ্জুর। এদিকে ইয়ার এন্ডিং-এর ঝামেলা চুকে গেছে শশাঙ্কের। অতএব নিষ্কণ্টক। শোভনা বলল, এবার ছুরি নাও।
প্রথমটা নিরুত্তর রইল শশাঙ্ক।
শোভনা বলতে লাগল, ছবছর ধরে ওরা চিঠি লিখছে-বোম্বাই-পাঞ্জাব ভাইজাগ–যেখানেই গেছে আমাদের যাবার জন্যে কত করে বলছে। কিন্তু কোথাও আমাদের যাওয়া হয়নি। ভেবে দেখো এবার না গেলে খুব খারাপ দেখাবে।
এবার মুখ খুলল শশাঙ্ক যাবে যাবে তোতা বলছ। কিন্তু খরচটার কথা ভেবেছ। হিসেব করে দেখ যাতায়াতের গাড়িভাড়া কত পড়ে। তাছাড়া ওখানে গেলে হাত টেনে চলা যাবে না। রীতিমতো খরচ করতে হবে। এবার যাওয়া বরং স্থগিত রাখো। পরে সুবিধামতো এক সময়
ছ বছর ধরে এই রকম এক-একটা অজুহাত খাড়া করে তার যাওয়া বন্ধ রেখেছে। শশাঙ্ক। প্রতিবারই শান্ত সহিষ্ণু মুখে সব মেনে নিয়েছে শোভনা। কিন্তু এবার যেন কী হয়ে গেল তার। ক্ষিপ্তের মতো বলে উঠল, কোথাও একটু বেরুতে পারি না। দম আমার বন্ধ হয়ে আসছে। ছবছর এ নরকে আমাকে আটকে রেখেছ। কিন্তু
কথা শেষ হল না তার। শশাঙ্কের ভাববর্জিত পিঙ্গল চোখ দুটা দপ করে উঠল। শোভনার মুখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সে দাঁতে দাঁত চাপল, নরক! আমি কিছুই লুকোইনি। তোমার বাবা এই নরক দেখেও তোমাকে আমার হাতে দিয়েছে। তাকে বললেই পারত একটা স্বর্গ ফুটিয়ে দিত।
শোভনা মরিয়ার মতো বলতে লাগল, তোমার কোনও কথা শুনতে চাই না। তুমি না যাও আমাকে রেহাই দাও। এখানে আমি আর পারছি না। এবার আমি মঞ্জুদের কাছে যাবই।
তা তো যাবেই। নইলে অনিমেষের সঙ্গে রাসলীলা চালাবে কেমন করে! ব্যঙ্গে ঠোঁট দুটো বেঁকে গেল শশাঙ্কের।