অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তারা। তারপর কাঁপা গম্ভীর গলায় সুশোভন। বলে, তোমার দাদা অমল এলে বলব, তুমি এলাহাবাদ যাবে না। আরেক বার আমরা চেষ্টা করে দেখি না। তুমি কী বল?
মণিকা উত্তর দেয় না। অনবরত তার মুখটা সুশোভনের বুকে ঘষতে থাকে।
একটু পর সুশোভন বুঝতে পারে, তার বুক চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে। মণিকার কান্না তার মধ্যেও বুঝিবা ছড়িয়ে পড়ে। ভাঙা ভাঙা, ঝাঁপসা গলায় বলে, ‘কেঁদো না, কেঁদো না।‘
আরণ্যক
আরণ্যক
ভাই টুপুদি,
মাসখানেক হল কানপুর থেকে আমরা ফরাসগাঁও এসেছি। জায়গাটা মধ্যপ্রদেশের সুদূর অভ্যন্তরে। এখানে দাঁড়িয়ে যে দিগন্তেই চোখ ফেরাই, শুধু পাহাড় আর পাহাড়। নীলাভ পাহাড়গুলো ঘর অরণ্যে রোমঞ্চিত হয়ে আছে। একটু ব্যাখ্যা করে বলি। রামায়ণে দণ্ডকারণ্যের কথা পড়েছিস তো। এ হল সেই জায়গা। সে-যুগে রামচন্দ্র এখনে বনবাসে এসেছিলেন। এ-যুগে পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য অরণ্য সংহার করে উপনিবেশ গড়ে উঠছে। খবরের কাগজের কল্যাণে এ খবর নিশ্চয়ই তোর অজানা নয়। সমস্ত এলাকাটা জুড়ে বিচিত্র এক জীবনযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে যেন।
সে যাই হোক, আমাদের ফরাসগাঁও আসার কারণটা এবার বলি। তোর ভগ্নীপতিটিকে তো জানিস একটা আস্ত বেদে। দুটো দিন কোথাও যদি স্থির হয়ে থাকতে পারে! ছবছর বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে কত চাকরি যে ছাড়ল, কত চাকরি ধরল আর নতুন নতুন কত জায়গায় না ঘুরল! এই ভ্ৰমণবাগীশটিকে নিয়ে আর পারি না।
তুই তো জানিস, বিয়ের পরই আমরা বোম্বাই চলে গিয়েছিলাম। ও তখন সেখানে চাকরি করত। বোম্বাই থেকে দুমাস পরেই গেলাম ভাইজাগ, ভাইজাগ থেকে পাঞ্জাব, পাঞ্জাব থেকে মাদ্রাজ সারা ভূমণ্ডল পাড়ি দিয়ে শেষ পর্যন্ত কানপুরে এসে বছরখানেক ছিলাম। ভেবেছিলাম, এতদিনে বেদেটা বুঝি শান্ত হল। কিন্তু ও মা, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ কানপুরের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে দণ্ডকারণ্য প্রোজেক্টে কাজ জুটিয়ে ফেলল। অগত্যা ফরাসগাঁও না এসে উপায় কী!
জানিস ভাই, এখানে একেবারে আরব্য রজনীর ব্যাপার। এখনও বাড়িঘর তৈরি হয়নি। তাঁবুর ভেতর থাকার ব্যবস্থা। তোর ভগ্নীপতিটির পাল্লায় পড়ে বাংলাদেশের ভীরু মেয়ে আমি, পুরোদস্তুর আরব বেদুইন বনে গেছি।
যাই হোক, প্রথম প্রথম ভীষণ ভয় করত। তাঁবু ছেড়ে এক পা-ও বেরুতাম না। ইদানীং ভয়টা গেছে। ধীরে ধীরে, সত্যি বলছি ভাই, দণ্ডক-বনের প্রেমে পড়ে গেছি। আমাদের এই ফরাসগাঁও থেকে দক্ষিণে গেলে চিত্রকুট। সেখানে চমৎকার একটা ফল্স্ আছে। কিন্তু এই বাহ্য। এখান থেকে উত্তরে পাড়ি জমালে কেশকাল পাহাড়ের চুড়ো সেখানে কাঁচ দিয়ে ঘেরা একটা রেস্ট হাউস আছে। চার পাশে নিবিড় বন–মধ্যপ্রদেশের রিজার্ভ ফরেস্ট। যে কোনও একটা রাত্রি সেখানে গিয়ে থাকলে কাচের স্বচ্ছ দেওয়ালের ওপরে দেখা যাবে বাঘ ভালুক আর বাইসনেরা ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখতে দেখতে রোমাঞ্চ হয়। ভয়ও লাগে। মনে হ্য, সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বহু শতাব্দী আগের এক হিংস্র আদিম জগতে ফিরে গেছি। ইতিমধ্যেই দুরাত আমরা সেখানে কাটিয়ে এসেছি। কেশকাল পাহাড়ের চুড়া আমার মনোহরণ করেছে।
ভাই টুপুদি, মনে পড়ে বিয়ের আগে মাঝে মাঝেই আমরা চিড়িয়াখানায় যেতাম। পিঞ্জরাবদ্ধ পশুগুলোকে দেখে তোর খারাপ লাগত। বলতিস ওদের মুক্ত প্রকৃতির মাঝখানে দেখতে ইচ্ছে করে। সংসার থেকে দিনকয়েকের ছুটি নিয়ে চলে আয় না। কেশকাল পাহাড়ের চুড়োয়, প্রকৃতির সেই স্বদেশে তোর ইচ্ছেপূরণ করে নিতে পারবি।
আমি জানি তোর ভগ্নীপতিটি এবং আমার ভগ্নীপতিটি–দুই ভায়রা একেবারে উল্টো স্বভাবের মানুষ। তোরটি বনের পাখি, সব সময় খালি উড়ু উড়ু। আমারটি খাঁচার পাখি। তা ভাই কয়েকটা দিনের জন্য খাঁচার পাখিটাকে দণ্ডকবনের অবাধ আকাশে এনে ছেড়ে দে।
দুবছর তোরও বিয়ে হয়েছে। এর মধ্যে কলকাতার ভিতর থেকে একটা দিনের জন্যেও বেরুসনি। অথচ ছেলেবেলা থেকেই বেড়াবার কত সাধ তোর। বিয়ের আগে এ নিয়ে কত গল্পই না করতিস। বোম্বাইতে থাকতে, পাঞ্জাবে থাকতে, কি কানপুরে থাকতে কতবার তোকে যেতে লিখেছি। তুই যাসনি। এবার কিন্তু কোনও অজুহাতই শুনব না। জামাইবাবু একান্ত না এলে ছেলেপুলেদের রেখে একাই চলে আসবি, নিশ্চই আসবি। কোনও অসুবিধে নেই। বোম্বাই মেলে রায়পুর স্টেশন থেকে আমরা তোকে নিয়ে আসতে পারব। যদি না আসিস জন্মের মতো আড়ি। ইতি–মঞ্জু।
বিকেলের ডাকে চিঠিটা এসেছে। একবার, দুবার, তিনবার, কতবার যে চিঠিখানা পড়ল শোভনা! তার আদরের নাম টুপু।
মঞ্জু তার আপন বোন নয়, ছোট কাকার মেয়ে। জেঠতুতো খুড়তুতো বোনদের মধ্যে মঞ্জুর জন্যেই শোভনার আকর্ষণটা সবচেয়ে বেশি। প্রায় আশৈশব। তার জন্যে মঞ্জুরও প্রাণের টান প্রবল। বোন বলল যথেষ্ট বলা হয় না; মঞ্জু ছিল তার সখী। বিয়ের আগে চলাফেরা ওঠা-বসা–সবই ছিল একসঙ্গে। স্কুল-কলেজে একই ক্লাসে পড়ত। তাছাড়া দুজনে প্রায় সমবয়সিও। শোভনা খুব বেশি হলে বছরখানেকের বড়।
কাকারা জেঠারা এবং শোভনারা নদীয়া জেলার এক মফস্বল শহরে একই বাড়িতে থাকত। একই বাড়িতে, তবে এক অন্নে আবদ্ধ ছিল না। বাড়িটা ছিল পূর্ব পুরুষের। শোভনার বাবা-কাকারা সেটা ভাগাভাগি করে নিয়েছিলেন। কাজেই বিয়ের আগে পর্যন্ত শোভনা আর মঞ্জু ছিল সর্বক্ষণ পরস্পরের সহচরী, সঙ্গিনী।