এক পলক কিছু ভাবল সুশোভন। তারপর বলল, ‘আরে বাবা, খেলাটা খেলাই। এটা তো আর লাইফ অ্যান্ড ডেধের ব্যাপার নয়। তাসের খেলায় তোরা না হয় জিতলিই। এই তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বউকে বকাবকি করতে যাওয়াটা মিনিংলেস।’ বলে চিন্তাটিস্তা না করেই হাতের তাসগুলো থেকে একটা বেছে টেবিলের ওপর ফেলল।
একটানা ঘন্টা দুয়েক খেলা চলল। তারপর সন্ধের আগে আগে পরিমল বলল, অনেকক্ষণ তাস হল। এবার চল, একটু বাইরে ঘুরে আসা যাক।
সুশোভন বলল, ফাইন। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে থেকে কোমর ধরে গেছে।
দশ মিনিটের ভেতর চারজন টপ ফ্লোর থেকে নিচে নেমে সুশোভনের গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়ল। ময়দানের চারপাশে চক্কর দিতে দিতে হঠাৎ পরিমল বলল, ‘অনেকদিন বাংলা নাটক দেখিনি। কলকাতায় এখন ভাল ড্রামা কী চলছে?
সুশোভন বলল, ঠিক বলতে পারব না। আমরাও অনেক দিন নাটক-টাটক দেখিনি। অ্যাকাডেমিতে গ্রুপ থিয়েটারগুলো রোজই নাটক করে। ওদের ড্রামায় একটা ফ্রেশ ব্যাপার থাকে। দেখবি নাকি?
পরিমল বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠল। বলল, চল না, দেখাই যাক।’
আহামরিও না, আবার খুব খারাপও না, একটা নাটক দেখে ফ্ল্যাটে ফিরতে ফিরতে সাড়ে নটা বেজে গেল।
.
রাত্তিরে খাওয়ার পর আরও কিছুক্ষণ আড্ডা-টাজ্ঞা দিতে দিতে পরিমলের হাই উঠতে লাগল। সে বলল, ‘ঘুম পাচ্ছে রে। এবার শুতে হবে। আমি আবার রাতটা বেশি জাগতে পারি না।
শোওয়ার কথায় চমকে উঠল সুশোভন। কেননা তার এই ফ্ল্যাটে মোটে দুটো বেডরুম। পরিমলদের যদি একটা ঘর ছেড়ে দেওয়া হয়, অন্য ঘরটায় তাকে আর মণিকাকে থাকতে হবে। অনেকদিন মণিকা এবং সে এক ঘরে রাত কাটায় না।
একটু ভেবে সুশোভন বলল, এক্ষুনি শোবার ব্যবস্থা হচ্ছে। এক কাজ করা যাক—’
‘কী?’
‘তুই আর আমি এক ঘরে শোব। আমাদের বউরা অন্য ঘরে। সেই কলেজ লাইফে তুই আর আমি কতদিন এক বিছানায় রাত কাটিয়েছি। এতদিন পর যখন একটা চান্স—’
সুশোভনের কথা শেষ হতে না হতেই প্রবল বেগে দুই হাত এবং মাথা নাড়তে নাড়তে পরিমল বলল, ‘নো নো, নেভার। কলেজ লাইফে যা হয়েছে, হয়েছে। এখন আমাদের ম্যারেজ লাইফ। বউকে ছাড়া আমি ভাই ঘুমোতে পারব না। পরক্ষণেই গলার স্বরটা ঝপ করে অনেকখানি নামিয়ে বলল, তুই কী রে, বউকে ফেলে আমার মতো একটা দুম্বো পুরুষের সঙ্গে শুতে চাইছিস! তোদের মধ্যে কোনওরকম গোলমাল টোলমাল হয়েছে নাকি?’ বলে রগড়ের ভঙ্গিতে হাসতে লাগল।
নেহাত মজা করার জন্যই কথাটা বলেছে পরিমল, কিন্তু সুশোভন এবং মণিকার শিরদাঁড়ার ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ চমকের মতো কিছু খেলে গেল। তাদের সম্পর্কটা কি বাইরের একজন মানুষের চোখে ধরা পড়ে গেছে? দ্রুত পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে নিল তারা। তারপর সুশোভনই আবহাওয়াটাকে সহজ করে নেবার জন্য। হেসে বলল, ঠিক আছে বাবা, তুই তোর বউয়ের কাছেই শুবি। ম্যারেজ লাইফের হ্যাবিট তোকে নষ্ট করতে হবে না।
সতীশকে দিয়ে একটা ঘরে পরিমল এবং সুজাতার বিছানা করে দেওয়া হল। এবং নিতান্ত নিরুপায় হয়েই অন্য ঘরটায় গিয়ে ঢুকল সুশোভন আর মণিকা। দরজায় তারা খিল দেয়নি। পান্না দুটো ভেজিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল দু’জনে। তারপর মণিকা আস্তে আস্তে ডান দিকে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
জানালার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে যে আকাশ দেখা যায় সেখানে হাজার হাজার তারা জরির ফুলের মতো আটকে আছে। রুপোর থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছে। অপার্থিব জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে কলকাতা।
শহর এখনও ঘুমোয়নি। নিচে অবিরত গাড়ি চলার শব্দ। অবশ্য হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের এই টপ ফ্লোরে বাতাসের ছাঁকনির ভেতর দিয়ে সেই আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে উঠে আসছে।
সুশোভন খুবই অস্বস্তি বোধ করছিল। দ্বিধান্বিতের মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর আস্তে করে বলল, ‘পরিমলটা ভীষণ ঝামেলায় ফেলে দিল।’
মুখ ফিরিয়ে এদিকে তাকায় মণিকা। সুশোভন কী বলতে চায়, সে বুঝেছে। ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিল সে।
সুশোভন এবার বলল, ‘আমি বরং এক কাজ করি।‘
আবার চোখ তুলে তাকায় মণিকা। তবে কিছু বলে না।
সুশোভন বলল, ‘আমি বাইরের ড্রইং রুমে গিয়ে শুই। তুমি এখানেই থাক। আধফোঁটা গলার মণিকা বলল, কিন্তু—’
‘কী?’
‘ড্রইং রুমে তো সতীশ শোয়। ওখানে—’
ইঙ্গিতটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। কাজের লোকের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাড়ির কর্তা গিয়ে শোবে, দৃশ্যটা একেবারেই মনোরম নয়। তাছাড়া সতীশ ভাববেই বা কী!
সুশোভন বলল, ‘তা হলে?’
ঘরের চারপাশ একবার দেখে নেয় মণিকা। তারপর বলে, তুমি শুয়ে পড়। আমি ওই জানালাটার ধারে সোফায় বসে থাকি। একটা তো রাত।
‘আজকের রাতটা না হয় না ঘুমিয়ে কাটাবে। কিন্তু পরিমলরা তো কয়েক দিন থাকছে। বাকি রাতগুলো?’
মণিকা কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই হঠাৎ পাশের ঘর থেকে টুকরো টুকরো হাসি, জড়ানো গাঢ় গলার আবছা আবছা কথা, চুমুর শব্দ, খুনসুটির আওয়াজ ভেসে আসতে থাকে।
চমকে মণিকা সুশোভনের দিকে একবার তাকাল। পরক্ষণেই মুখ নামিয়ে নেয়। আর সুশোভনের সমস্ত অস্তিত্বের ভেতর দিয়ে তীব্র স্রোতের মতো অনেকক্ষণ, একটানা কী যেন বয়ে যেতে থাকে। নিজের অজান্তেই কখন যে সে মণিকার কাছে চলে এসেছে, জানে না। কোনও এক অভ্রান্ত নিয়মে তার হাত মণিকার কাঁধে উঠে। আসে। সঙ্গে সঙ্গে কী এক অলৌকিক বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটে যায়। হঠাৎ সুশোভন টের পায় মণিকার মুখ তার বুকের ওপর আটকে আছে এবং মণিকার শরীরটাও ক্রমশ তার শরীরের ভেতর মিশে যাচ্ছে।