- বইয়ের নামঃ প্রফুল্ল রায়ের গল্প
- লেখকের নামঃ প্রফুল্ল রায়
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
আগুন
চিঠিখানা এসেছে সকালের ডাকে। নীল খামের চিঠি। পাওয়ামাত্রই সেটা খুলতে পারেননি সুনীতি। তখন সে অবকাশ ছিল না।
স্বামী পাবলিক প্রসিকিউটর; সাড়ে দশটায় তাকে কোর্টে হাজিরা দিতে হয়। বড় ছেলে বিমল লক্ষৌয়ে একটা ব্যাঙ্কের বিরাট অফিসার; নটার লোকাল ট্রেনটা ধরতে না পারলে লেট হওয়া অবধারিত। ছোট ছেলে কমল আর একমাত্র মেয়ে সুরভি কলেজে পড়ে; তাদের ক্লাসও এগারোটার মধ্যেই।
এদিকে কপালগুণে যে রাঁধুনিটা জুটেছে তার নড়তে চড়তেই প্রহর কাবার। অতএব সবার সঙ্গে তাল দিয়ে ফিরতে ফিরতে সকালের দিকটা চোখে আর কিছু দেখতে পান না সুনীতি। অবশ্য বড় ছেলের বিয়ে দিয়েছেন। বউমাটি হয়েছে মনের মতো; সব সময় তাঁর পায়ে পায়ে ঘুরে ঝক্কিগুলো ভাগাভাগি করে নেয়।
যাই হোক অফিসযাত্রী, কলেজযাত্রী আর এজলাসযাত্রীদের যার যার গন্তব্যে পাঠিয়ে দিয়ে খাওয়ার পালা চুকিয়ে যখন খামখানা হাতে নিয়ে বসলেন তখন দক্ষিণায়ণের সূর্য পশ্চিম আকাশের ঢাল বেয়ে অনেকখানি নেমে গেছে। সময়টা অঘ্রাণের মাঝামাঝি; এর মধ্যেই উত্তর প্রদেশের শীত বেশ সমারোহ করেই নামতে শুরু করেছে। রোদটা স্তিমিত, নিষ্প্রভ, অনুজ্জ্বল। বাতাসেও বেশ টান ধরেছে।
খামটা হাতে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন সুনীতি। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তার নামে চিঠি আসে। দাদারা লেখেন, দিদিরা লেখেন, বাবা-মা লেখেন। তাঁদের হাতের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত। কিন্তু এই খামটার ওপর যে নাম-ঠিকানা রয়েছে সে হস্তাক্ষর তার সম্পূর্ণ অচেনা। কিছুটা বিস্ময়ের বশে, কিছুটা বা কৌতূহলে নীল আবরণ ছিঁড়ে চিঠিটা বার করে পড়তে লাগলেন সুনীতি।
প্রিয়ংবদে না সুহাসিনী, কী নামে সম্বোধন করব, বুঝে উঠতে পারছি না। এখনও তোমার কথা শুনলে হৃদয় ময়ুরের মতো পেখম মেলে কিনা অথবা হাসলে সুধা ঝরে কিনা, কিছুই জানা নেই। অতএব সম্বোধনের বালাইটুকু বাদ দিলাম।
খবর পেয়েছি চুটিয়ে সংসার করছ। তোমার স্বামী কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগার করেন; বড় ছেলেটিও কৃতী হয়েছে। অন্য ছেলেমেয়েরাও বেশ ভালো; বড়বউমাটিও চমৎকার। অতএব আশা করি সুখ আর টাকার টনিকে ফুলে ফুলে একটি মৈনাক পর্বত হয়ে উঠেছ। অবশ্য এটা আমার নিছক অনুমান।
একদিন দেখেছিলাম হরিণীর মতো তোমার চোখ। মেঘের মতো চুল, চম্পাকলির মতো আঙুল, নবীন বর্ষার সজীব লতাটির মতো শরীর। সেই যে তোমাদের কবি কী যেন ছাই বলেছেন, মধ্যে ক্ষীণা, নিম্নে বিশালাঃ, নগ্রোধপরিমণ্ডলা, তা-ই ছিলে তুমি। আমার দেখা তুমি আর আমার অনুমান করা তুমি, এই দুয়ের ভেতর মিল আছে কিনা বড় জানতে ইচ্ছে করছে।
একদিন তো ছিলে সুললিতে রসবতী; প্রাণটি ছিল সরোবরের মতো টলটলে। সে সরোবর মজে হেজে বুজে গেছে কিনা কে বলবে! বুধবার পাঁচটা নাগাত এলাহাবাদ থেকে লক্ষৌ যাবার পথে আমার ট্রেনটা তোমাদের স্টেশনে মিনিট দশেকের জন্য দাঁড়াবে।
যমনাপুলিনে কৃষ্ণকানাইয়ার বাঁশি শুনে শ্রীরাধিকে যেমন লোকলজ্জা ভুলে বেরিয়ে আসত, একদিন আমার ডাকে তুমিও তেমনি আসতে পারতে। আমার সেই সুখের দিন আজ আর আছে কিনা, জানি না। যাই হোক, ইতিতে নামটা দিলাম না। চিনতে পারলে স্টেশনে এসো।
চিঠিখানা পড়ে ভ্রুকুঞ্চিত করলেন সুনীতি; যারপরনাই বিরক্ত হয়েছেন তিনি। তার চিঠি এলে সবাই খুলে পড়ে। ভাগ্যিস আগেভাগে কেউ খোলেনি; খুললে কারো দিকে মুখ তুলে তাকানো যেত না।
ইতির পর নাম নেই, তবু পলকেই চেনা গেল। এমন চিঠি একটি মানুষই নিক্ষেপ করতে পারেন। তিনি সোমনাথ। তার মতো মাত্রাজ্ঞানহীন বাঁচাল-চুড়ামণি জগতে আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।
সোমনাথের ওপর বিরক্ত হয়েও হঠাৎ উজান টানে জীবনের পিছন দিকে ফিরলেন সুনীতি এবং মুহূর্তে স্মৃতির ভেতর বিভোর হয়ে গেলেন।
এক-আধটা দিন নয়, প্রায় তিরিশ বছর হয়ে গেল। মনে পড়ছে, তখন তাঁর বিয়ে হয়নি। কলকাতায় বাপের বাড়ি। সেখানেই থাকতেন।
বড়দির বিয়ে হয়েছিল হাওড়ায়, মেজদির বর্ধমানে, কিন্তু সেজদির বিয়ে হয়েছিল সুদূর পাঞ্জাবে। চাকরির খাতিরে সেজ জামাইবাবুরা ওখানকার প্রবাসী। বড়দি-মেজদির সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত কিন্তু সেজদির পক্ষে পাঞ্জাব থেকে যখন তখন আসা সহজ নয়। বিয়ের পর বার দুই এসে আসাটা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর বছর তিনেক চিঠিপত্র ছাড়া আর যোগাযোগ ছিল না।
মনে পড়ছে সেবার বাবার খুব অসুখ। সেজদিকে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। সেজ জামাইবাবু আসতে পারেননি। এক দেওরকে সঙ্গে করে সেজদি চলে এসেছিলেন। সেজদির সেই দেওরটিই সোমনাথ।
সেজদিরা এসে পৌঁছবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। যাই হোক, এতদিন পর সেজদি আসায় বাড়িতে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছিল। তবে উৎসবের ঘটাটা তার দেওরটিকে নিয়েই বেশি হয়েছিল।
সেজদির দেওরটি অর্থাৎ সোমনাথ অসাধারণ কৃতী ছাত্র। সে-সময় ইউনিভার্সিটিতে অঙ্কের দুরূহ একটা বিষয় নিয়ে কী গবেষণা করছিলেন। দেখতেও চমৎকার। তীক্ষ্ণ নাক, মেদহীন দীর্ঘ শরীর, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, উজ্জ্বল কপাল, স্বণাভ গাত্রবর্ণ-সব মিলিয়ে আশ্চর্য সুপুরুষ। এটুকুই তাঁর পরিচয় নয়। ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন, আবৃত্তি করতে পারতেন সুন্দর। তাছাড়া ছিলেন অত্যন্ত হাসিখুশি, রগুড়ে, আমোদপ্রিয় এবং বোধহয় কিঞ্চিৎ ফাজিলও। এসেই সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন সোমনাথ।