মিস ঘোষ, তার আর প্রয়োজন হবে না। আপনি ফিরে যান। আয় সুব্রত। কিরীটী বেশ দ্রুতপদেই গেট অতিক্রম করে পাহাড়ের গা দিয়ে ঢালু পথ বেয়ে এগিয়ে চলল। আমি কতকটা একপ্রকার বাধ্য হয়েই অতঃপর কিরীটীকে অনুসরণ করি।
এগিয়ে চলেছি অন্ধকার পথ ধরে আবার হোটেলের দিকে।
শীতের কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি হলেও কালো আকাশটা তারায় তারায় যেন ঝকঝক করছে। বাঁয়ে কালো কালির মত গর্জন-উদ্বেলিত সমুদ্র।
মাঝামাঝি পথ আসতেই দূরে হোটেলের আলোগুলো অন্ধকার আকাশপটে ক্ৰমে ফুটে উঠতে লাগল। কিরীটী নিঃশব্দে পথ অতিক্রম করছিল, এতক্ষণ একটি কথাও বলেনি। কিন্তু কিরীটীর নিস্তব্ধতা আমাকে যেন কেমন পীড়ন করছিল। আমিই কথা বললাম, হিরন্ময়ী দেবীকে কেমন লাগল, কিরীটী?
কেন, ভদ্রমহিলা বেশ ভালই তো!
হরবিলাসের উপরে একটা অসাধারণ হোল্ড রয়েছে বলে যেন মনে হল!
স্বাভাবিক। ধনীর কন্যা বিবাহ করলে স্বামীকে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই স্ত্রীর মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় ও মধ্যে মধ্যে স্ত্রীর আজ্ঞাবহুও হতে হয়। বিশেষ করে আবার এক্ষেত্রে শ্রীমতী হিরন্ময়ী দেবীর মত প্রখর বুদ্ধিমতী নারীর কাছে হরবিলাসের একটা inferiority complx থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
কিন্তু তা তুই ভাবছিস না, অন্য কিছু ভাবছিস! আমি আবার কিরীটীর চিন্তান্বিত মনটাকে একটা খোঁচা দিয়ে আমার প্রতি সজাগ করে তোলবার চেষ্টা করি।
এবং কিরীটীর পরবর্তী জবাব শুনে বুঝলাম প্রচেষ্টা আমার একেবারে নিষ্ফল হয় নি। কিরীটী মৃদু হাস্যসহকারে জবাব দিল, শতদলবাবু যে আজ সকালবেলাতে বললেন এই বাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী এখন তিনিই, তা তো কই মনে হচ্ছে না। তিনি নাতি এবং হিরন্ময়ী দেবী বোন। সেদিক দিয়ে শ্রীমতী সীতাও তো মালিকের নাতনী। আরো আছে কিনা তাই বা কে জানে!
এতক্ষণে বুঝতে পারি কিরীটীর বর্তমান চিন্তাধারাটা ঠিক কোন পথ ধরে চলেছে। সকালবেলাকার আকস্মিক দুর্ঘটনা থেকে শতদলের রহস্যটাই তার সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এবং এও বুঝতে পারলাম, শতদলরহস্য মীমাংসিত না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে কিরীটী নড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে আমারও নড়া চলবে না। অতএব অনির্দিষ্ট কালের জন্য এখন এখানেই অবস্থানও হবে অবধারিত।
বস্তুতঃ শতদলের রহস্যটা যে আমার মনকেও বেশ কিছুটা চঞ্চল করে তোলেনি তা নয়। কিন্তু কোন কিছুরই যেন হদিস পাচ্ছিলাম না। সকাল হতে কতকগুলো ছিন্ন ছিন্ন ঘটনা ও কয়েকটি বিভিন্ন চরিত্রের নর-নারী যার সংস্পর্শে আমরা এসেছি, কোন কিছুর মধ্যেই যেন একটা পূর্ণ যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সহসা একটা প্রশ্ন আমার মনের অন্ধকারে বিদ্যুৎ-চমকের মতই যেন ঝিলিক হেনে গেল, কিন্তু কিরীটীকে সে প্রশ্নটা করবার পূর্বেই সে আমাকে বললে, রাত আটটা বাজে প্রায়, একটু পা চালিয়ে চল সুব্রত, হোটেলের ক্লাব-ঘরে বহু জনসমাগম হয়, দেখা যাক আজ তাদের মধ্যে কারো সঙ্গে একটু-আধটু আলাপ-পরিচয় করা যায় কিনা। এতদিন এখানে এসেছি, হোটেলে আছি, অথচ কারো সঙ্গে আলাপ হল না! এ অন্যায়। চল।
হোটেলে এসে যখন পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা।
কিরীটী ও আমি সোজা একেবারে হোটেলের নিচের তলায় যে হলঘরটি স্থানীয় ক্লাব-ঘর বলে এখানে পরিচিত, সেই ঘরে এসে প্রবেশ করলাম।
প্রশস্ত হলঘরটি তখন হোটেলের ও স্থানীয় অধিবাসী নরনারীতে গমগম করছে। বলতে গেলে হোটেলে আসবার পর এই সর্বপ্রথম ঐ ঘরে আমাদের পদার্পণ।
হলঘরের একধারে কাউন্টার। সেখানে উর্দি-পরা হোটেলের ওয়েটার নানাজাতীয় কড়া ও নরম পানীয়ের বোতলগুলো সাজিয়ে তৃষিতজনদের পানীয় পরিবেশন করছে। মধ্যে মধ্যে ছোট-বড় সব চৌকো ও গোলাকর টেবিল ও চেয়ার পাতা। সেই চেয়ারগুলো অধিকার করে নানাবয়সী নরনারীর ভিড় জমেছে। উচ্চ ও চাপা হাসির গুঞ্জন ও তর্কাতর্কির শব্দে সমগ্র হলঘরটি মুখরিত। চারদিকেই সর্বত্র একটা আনন্দঘন উচ্ছাসের সাড়া। কেউ গল্প করছে, কেউ তাস খেলছে, কেউ দাবা, কেউ টেবিল-টেনিসু আবার কেউ কেউ বা পানীয়ের ক্লাসে নিয়ে বসে আছে ও মধ্যে মধ্যে এক-আধ সিপ ড্রিংক করে স্বপ্নালু দৃষ্টিতে আশেপাশে চেয়ে দেখছে।
ঘরের এক কোণে একটা গোলাকার খালি টেবিলের পাশে খানতিনেক খালি চেয়ার পড়েছিল। কিরীটী আমাকে আকর্ষণ করে সেই দিকে নিয়ে গেল। এবং নিজে একটা চেয়ারে বসে আমাকে বললে, বোস।
পকেট থেকে চামড়ার সিগারের কেসটা বের করে একটা সিগার কেস থেকে নিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললে, যস্মিন দেশে যদাচারঃ-কী খাবি বল?
চেয়ে দেখি ইতিমধ্যে আমাদের চেয়ারে বসতে দেখে একসময় একজন উর্দিপরিহিত ওয়েটার আমাদের সামনে জার্মান-সিলভারের একটা ট্রে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
একঠো ছোটা বিয়ার অ্যান্ড জিন—তুই কী খাবি বল সুব্রত?
আমি—মানে ওসব আমার চলবে না ভাই।
এক যাত্রায় পৃথক ফল নেই, you must keep company! আর দেখো, এ সাবকে লিয়ে একঠো ছোটো জিন অ্যাণ্ড লাইম লাও!
ওয়েটার সেলাম জানিয়ে কাউন্টারের দিকে চলে গেল।
কিন্তু ভাই, ওসব খেয়ে যদি মাতাল হই? ভয়ে ভয়ে কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম।
একটা ছোট জিন অ্যাণ্ড লাইম খেয়েই মাতাল হবি? Rubbish!
অভ্যাস নেই যে ভাই।
আমার যেন কতকালের অভ্যাস আছে! থাম।