হরবিলাস বোধ হয় এতক্ষণ ঘরের মধ্যেই ছিলেন, বের হয়ে এলেন। নিঃশব্দে এগিয়ে এসে হিরণ্ময়ীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা স্ত্রীর কন্ধের ওপরে রাখলেন। মৃদুকঠে ডাকলেন, হিরণ!
তথাপি নিশ্চল স্তব্ধ হিরণ্ময়ী। এতটুকু কম্পনও নেই। স্বামীর ডাক যেন তাঁর কানে পৌঁছয়নি।
ঘরে চল হিরণ! তথাপি হিরণ্ময়ীর দিক থেকে কোন সাড়া এল না। পূর্ববৎ নিশ্চল স্তব্ধ। হিরণ! আবার মৃদুকণ্ঠে ডাকলেন হরবিলাস।
স্বামী-স্ত্রীর এই শোকের মধ্যে নিজেকে কেমন যেন আমার বিব্রত মনে হতে লাগল। এমন সময় এখানে না থাকাই উচিত বোধ হয়। স্থানত্যাগ করাই কর্তব্য।
আচমকা এমন সময় হিরণ্ময়ীর পাথরের মত স্তব্ধ দেহটা ঈষৎ নড়ে উঠল। হিরণ্ময়ী স্বামীর দিকে চোখ তুলে তাকালেন। নিষ্প্রাণ অর্থহীন দৃষ্টি। স্বামী ডাকলেও যেন কিছু বুঝতে পারেননি তিনি।
ঘরে চল।
১৭৬
সীতাকে কি ওরা নিয়ে গিয়েছে? ক্ষীণকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন হিরণ্ময়ী।
ঘরে চল হিরণ। স্নিগ্ধ কণ্ঠে হরবিলাস কেবল বললেন।
তুমি দেখেছ? সত্যিই সীতা মরে গিয়েছে? মনে নেই তোমার, ছোটবেলায় ওর ফিটের ব্যামো ছিল! ফিট হয়নি তো? সত্যিই হয়তো ও মরেনি, ফিট হয়ে আছে। Smelling Salt-এর শিশিটা নিয়ে যাও–
না, তুমি ঘরে চল।
না, ঘরে যাব না। এখান দিয়েই তো সীতাকে ওরা নিয়ে যাবে!
তা তো জানি না। ওসব কথা আর ভেবে কী হবে হিরণ? মনকে শক্ত করা ছাড়া তো আর উপায় নেই।
কিরীটীবাবু, কোথায়?
উপরেই আছেন।
তিনি কি বললেন? তিনিও ধরতে পারলেন না কে আমার সীতাকে খুন করল?
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎ হিরণ্ময়ী দেবী চুপ করে রইলেন, তারপর আবার যেন আপন মনেই বলে উঠলেন, সে ঠিক ধরতে পারবে, আমার সীতাকে কে মেরেছে। সে ধরতে পারবে—পারবে।
ক্ষীণ পদশব্দ কানে এল।
চেয়ে দেখি ঘোষাল ফিরে আসছেন, আমিও আর বিলম্ব না করে পা টিপে টিপে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম। সত্যিই ঐ শোকের দৃশ্য যেন আর সহ্য করতে পারছিলাম না।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে দেখি, কিরীটী নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে আপনমনে পায়চারি করছে। মুখে পাইপ। শতদলবাবু সোফার ওপরে যেমন অর্ধশয়ান অবস্থায় ছিল তেমনই আছে।
আমার পদশব্দে কিরীটী পায়চারি থামিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ঘোষাল কই?
আসছেন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘোষাল ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।
ডাক্তারকে ডাকতে লোক পাঠিয়েছেন?
হ্যাঁ। বিপিনও সেই লোকটির কথা বললে মিঃ রায়।
কার কথা?
মিস সেন যে লোকটির কথা বলছিলেন! লোকটাকে বিপিন সদর দিয়ে বের হয়ে যেতে দেখেছে। রাত তখন পৌনে নটা হবে।
আসতে দেখেনি লোকটাকে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
না। কেবল বের হয়ে যেতেই দেখেছে। তবে মিস সেন তার বেশভুষার যে description দিয়েছেন তার সঙ্গে মিল নেই।
কি রকম?
গায়ে একটা কালো রঙের গ্রেট কোট ছিল, আর মাথায় একটা কালো রঙের ফেল্ট ক্যাপ ছিল। ক্যাপটা ডানদিকে একটু টেনে নামানো ছিল। চেহারার বর্ণনায় মিল আছে। উঁচু, লম্বা বলিষ্ঠ গড়ন। এবং সদর দিয়ে বের হয়ে যাবার সময় সদরের আলোয় লোকটার মুখের একাংশ যা দেখতে পেয়েছিল, বললে মুখে নাকি খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল, কিছুদিন যে লোকটা shave করেনি বোঝা যায়।
ঘোষালের কথা শেষ হতেই কানে এল একটা কুকুরের গরুগম্ভীর ডাক।
চমকে উঠেছিলাম প্রথমটায়, পরক্ষণেই মনে পড়ল সীতার কুকুরের ডাক। আজ সন্ধ্যায় এখানে লোকসমাগমের জন্য সীতার কুকুরটাকে নিচের তলার একটা ঘরে চেন দিয়ে বেধে রাখা হয়েছিল।
ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে ডাকতে কুকুরটা একলাফে ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করল এবং সোজা এসে সীতার ভূপতিত নিষ্প্রাণ হিমশীতল দেহটার সামনে দাঁড়িয়ে গেল।
সকলেই আমরা স্তব্ধ-বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি অ্যালসেসিয়ান প্রকাণ্ড কুকুরটার দিকে। স্থির দৃষ্টিতে সীতার মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুকুরটা।
হঠাৎ কুকুরটা হাঁটু ভেঙে সীতার মৃতদেহের সামনে বসে পড়ল। তারপর মুখটা সীতার গায়ের উপর রেখে কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল।
কুকুরটা কাঁদছে।
অত বড় একটা জানোয়ার যে অমন করে তার প্রভুর জন্য কাঁদতে পারে, অমন করে তার শোক প্রকাশ করতে পারে, দেখে সত্যিই যেন বিস্ময়ের অবধি ছিল না। নির্বাক আমরা সকলেই। একটা জানোয়ারের শোকপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে সমস্ত ঘরের আবহাওয়াটাও যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে।
ঠিক এমনি সময় হাঁপাতে হাঁপাতে খালি গায়েই হরবিলাস ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। হাতে তাঁর কুকুর বাঁধার মোটা শিকলটা।
কুকুরটা কিছুতেই তাঁর প্রভুর মৃতদেহের পাশ হতে নড়বে না। একপ্রকার জোর করেই গলার বকলসে শিকল এঁটে হরবিলাস কুকুরটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন।
রাত প্রায় পৌনে বারোটায় ডাক্তার আদিত্য চ্যাটার্জী এলেন, বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। দার্শনিকের মত এলোমেলো কাঁচা-পাকা চুল। মিঃ ঘোষালই ডাঃ চ্যাটার্জীর সঙ্গে আমাদের সকলের পরিচয়টা করিয়ে দিলেন এবং নিরালার দুর্ঘটনাটাও সংক্ষেপে তাঁর গোচরীভূত করলেন।
ডাঃ চ্যাটার্জী ওখানকার অনেক দিনের বাসিন্দা। শহরেই প্র্যাকটিস করেন এবং নিজের একটি ছোটখাটো নার্সিং হোমও আছে। মিঃ ঘোষালের মুখে সমস্ত কাহিনী শুনে তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। কেবল একবার মৃদুকণ্ঠে বললেন, How horrible!