চলুন শতদলবাবু উপরে আপনার ঘরে যাওয়া যাক। রঘু, দারোগাবাবুকে উপরের ঘরে নিয়ে এস। রঘুর দিকে তাকিয়ে কিরীটী নির্দেশ দিল।
শতদলবাবুকে নিয়ে আমরা অন্দরমহলে তাঁর ঘরের দিকে অগ্রসর হলাম, রঘু বাইরে চলে গেল দারোগাবাবুকে ডাকতে।
স্থানীয় থানা-ইনচার্জ রসময় ঘোষাল, বয়স তেত্রিশের বেশী হবে না।
ভদ্রলোকের বোধ হয় নিয়মিত ব্যায়াম করা অভ্যাসু বেশ বলিষ্ঠ পেশীবহুল চেহারা। লোকটি কথাবার্তায় অত্যন্ত অমায়িক। আমি কিরীটীর পরিচয় দিতে তিনি সোল্লাসে এগিয়ে এসে কিরীটীর সঙ্গে করমর্দন করলেন, কী সৌভাগ্য, আপনিই মিঃ কিরীটী রায়?
ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে আমিও যেন মনে মনে অনেক স্বস্তি পাই। অন্ততঃ এর পর প্রতি পদে যার সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে হবে, তাঁর মধ্যে কোন পলিসী অহমিকা বা গাম্ভীর্য নেই। সত্যিই ভদ্রলোক।
কিরীটীই শতদলবাবুর সঙ্গে ঘোষাল সাহেবের পরিচয়টা ঘটিয়ে দিল, ইনিই শতদলবাবু এই বাড়ির মালিক; ইনিই আপনাকে চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন মিঃ ঘোষাল।
বলতে লজ্জা নেই মিঃ রায়, আমি কিন্তু ওঁর চিঠিতে আপনি এখানে উপস্থিত জেনেই, থানার সমস্ত কাজ ফেলে তাড়াতাড়ি এখানে ছুটে এসেছি। কী আশ্চর্য দেখুন, আপনি এখানে এসেছেন জানতেও পারিনি।
মিঃ ঘোষালের কথা শুনে শতদল একবার ঘোষালের দিকে তাকালেন।
কিরীটীর দিকে চেয়ে দেখি, কিরীটী কিন্তু মৃদু মৃদু হাসছে। ব্যাপারটার মধ্যে যে হাসির কি কারণ থাকতে পারে সেদিন ঐ মুহূর্তে বুঝিনি, পরে যখন রহস্যটা উপলব্ধি করেছিলাম—থাক, সে কথা, বহুবার বহু ক্ষেত্রে দেখেছি, কিরীটীর অত্যাশ্চর্য অনুসন্ধানী দৃষ্টি রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে সর্বদা এমন ভাবে সজাগ থাকে যে, ভাবতেও বিস্ময়ে যেন অভিভূত হয়ে যেতে হয়। শুধুমাত্র তাই নয়, বহুক্ষেত্রে তুচ্ছাদপি তুচ্ছ ঘটনা, অনেক সময় যার কোন তাৎপর্যই হয়তো আমরা খুঁজে পাই না,—কিরীটী প্রবলভাবে সেইটার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। এবং বারংবার সেইটা নিয়েই নাড়াচাড়া করতে থাকে নিজের মনের গভীর তলদেশে। কিরীটীকে ঐ সম্পর্কে পরে প্রশ্নও করেছি। জবাবে সে বলেছে, প্রত্যেক মানুষেরই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ আছে সুব্রত এবং তার বিচার-পদ্ধতিটাও মানুষ-বিশেষে বিভিন্ন। সামান্য একটা তুচ্ছ ঘটনা, যা হয়তো অনেকেরই চিন্তায় রেখাপাতও করে না, অনেক সময় সেই তুচ্ছর মধ্যেই আমি রহস্যেরই ইঙ্গিত পাই।
কিরীটীর কথায় আবার আমার সম্বিৎ ফিরে এল, তাহলে আপনাকে আগাগোড়া ব্যাপারটা খুলেই বলি, মিঃ ঘোষাল। যদিও ব্যাপারটার মধ্যে কাল পর্যন্তও শতদলবাবু কোন গুরুত্বই আরোপ করেন নি এবং গতরাত্রি থেকে কতকটা বাধ্য হয়েই মত পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছেন, সেটা হচ্ছে ভদ্রলোক বর্তমানে সত্যিই বিপন্ন হয়ে পড়েছেন। আমরা সোজা করে বললে বলা উচিত, শতদলবাবুর প্রাণ কয়েক দিন থেকে বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
বিপন্ন হয়ে উঠেছে, কী রকম? প্রশ্ন করে ঘোষাল মশাই কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
Somebody is after his life!
বলেন কী? সত্যি?
হ্যাঁ, চার-চারটে attempt, অর্থাৎ অত্যন্ত সাধুপ্রচেষ্টা ওঁর জীবনের ওপরে হয়ে গিয়েছে!
চার-চারবার attempt হয়েছে?
হ্যাঁ। প্রথমবার, ঐ যে দেখছেন খাটের পাশে মাটিতে নামানো বড় অয়েল পেনটিংটা, ঐটাই বোধ হয় ওঁর অজ্ঞাতে কোন এক সময় এমন কায়দা করে ফিট করে রাখা হয়েছিল, যাতে করে রাত্রে ঘুমের ঘোরে কোন এক সময় সহসা ছবিটা মাথার উপরে ছিড়ে পড়ে ওঁর মাথাটা থেতলে দিয়ে ওঁর মত্যু ঘটায়। যদিও ব্যাপারটা গতকালই মাত্র ওঁর মুখে শোনা, আজ ঘরে ঢুকে একসময় ইতিপূর্বে ঐ ছবিটার প্রতি নজর দিয়েই আমি দেখেছি এবং আপনিও ইচ্ছা করলে এগিয়ে গিয়ে দেখে আসতে পারেন, ছবিটা টাঙানো ছিল একটা মোটা তার দিয়ে এবং সে তারটাকে এমন ভাবে সামান্য একটু অংশ বাকি রেখে কাটা হয়েছে যে ছবির ভারে বাকি তারের অংশটুকু ছিড়ে পড়া একসময় এমন কিছুই বিচিত্র নয়।
কিরীটীর কথা শুনে আমরা সকলেই খাটের পাশে নামিয়ে রাখা ছবিটির দিকে তাকালাম এবং বুঝলাম কিরীটীর কথাটা মিথ্যা নয়। গতকাল সকালে হোটেলের সামনে সী-বীচে শতদলবাবু ছবি সম্পর্কে কিরীটীকে কী বলেছিলেন ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ আবার হঠাৎ কিরীটীর কথায় মনে পড়ে গেল।
এগিয়ে গেলাম সকলে কিরীটীর সঙ্গে-সঙ্গেই ছবিটার দিকে।
যে তারের সাহায্যে ছবিটা দেওয়ালে পেরেকের সঙ্গে পাকাপোক্তভাবে টাঙানো ছিল, দেখলাম পরীক্ষা করে, সত্যি সত্যিই সে তারটা কোন কিছুর সাহায্যে এমন ভাবে কাটা যে বাকি যে অংশটুকু কাটা ছিল না সেটা ছবির ভারেই ছিড়ে গিয়েছে। কিরীটী কথাটা ভোলেনি এবং আজ ঘরে প্রবেশ করে অন্যান্য কথাবার্তার মধ্যেও ছবিটাকে লক্ষ্য করেছে এবং বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই সবটকু লক্ষ্য করেছে ইতিমধ্যেই। কিরীটী আবার বলতে লাগল, তারপর দ্বিতীয়বার attempt হয় এই বাড়ির বাইরে। এখানে আসবার সময়ই লক্ষ্য করে থাকবেন হয়তো মিঃ ঘোষাল, বাড়ির গেট থেকে যে রাস্তাটা বরাবর সামনের দিকে চলে গিয়েছে, বাড়িটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত বলে রাস্তাটা ক্ৰমে ঢালু হয়ে নিচে গিয়েছে, সেই ঢালু রাস্তা দিয়ে একসময় শতদলবাবু যখন অন্যমনস্ক হয়ে নিচে নেমে যাচ্ছেন, পিছন থেকে কেউ একটা বড় পাথরের চাঁই গড়িয়ে দিয়ে ওঁকে পিষে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেছিল।