বেশ তো। তাহলে রাণু দেবী যাবেন নাকি!
কখন যাবেন? রাণু প্রশ্ন করে।
একটু সকাল-সকালই না হয় বের হওয়া যাবে। কিরীটী জবাব দেয়।
হঠাৎ একটা ভারিক্কী মেয়েলী কণ্ঠে সামনের দিকে তাকালাম। এই যে রাণু, কোথায় ছিলি এতক্ষণ? সেই কখন বের হয়েছিস–
একটি বিধবার বেশ পরিহিতা মধ্যবয়সী মহিলা। পরিধানে বিধবার বেশ থাকলেও ঐশ্বর্য ও আভিজাত্যের চিহ্ন যেন তাঁর চোখ-মুখ হাব-ভাব, এমন কি দাঁড়াবার ভঙ্গীটকু থেকে পর্যন্ত ফুটে বের হচ্ছে। পরিপাটি চুল আঁচড়ানো। হাতে একগাছি করে সোনার চুড়ি। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা।
কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আবার মহিলা প্রশ্ন করলেন।
এই—মানে, বলতে বলতে এদিক-ওদিক তাকায় রাণু।
চেয়ে দেখি, আমাদের ধারে-কাছে কোথাও শতদলের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। কখন একসময় ইতিমধ্যেই নিঃশব্দে অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে সে গা-ঢাকা দিয়েছে।
০৪. ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে
এরা কে রাণু? ভদ্রমহিলা রাণুর দিকে তাকিয়ে আমাদের ইঙ্গিত করে প্রশ্ন করলেন।
রাণু যেন শতদলের আকস্মিক অন্তর্ধানে কতকটা আরাম অনুভব করে এবং একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার মা। ইনি মিঃ কিরীটী রায়, ইনি মিঃ সুব্রত রায়। মিঃ কিরীটী রায়ের নাম তুমি নিশ্চয়ই শুনে থাকবে মামি– বিখ্যাত রহস্যভেদী।
নমস্কার, মিঃ রায়—আমার স্বামীর নাম নিশ্চয়ই আপনি শুনে থাকবেন–স্যার আর. এন. মিত্র–
কোন স্যার আর, এন.? বিখ্যাত মার্চেন্ট, গত বৎসর সুইজারল্যান্ডে যিনি অপারেশন হতে গিয়ে মারা যান?
হ্যাঁ। পৃথিবীবিখ্যাত সার্জেনদের দিয়ে অপারেশন করানো হল এখান থেকে ফ্লাই করে গিয়ে…কিন্তু oh dear! He could not be saved– লেডি মিত্র হাতের দামী সুগন্ধযুক্ত রেশমী রুমালটা চোখের উপরে একবার বুলিয়ে নিলেন এবং মনে হল গলার স্বরটা যেন একটু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছে।
হ্যাঁ, সংবাদপত্রে ঘটনাটা পড়েছিলাম। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।
শ্ৰীমতী রাণু তাহলে ক্রোড়পতি স্যার আর. এন.-এর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারিণী এবং শ্রীমান শতদল তাহলে বেশ উঁচু ডালের দিকে হস্ত প্রসারিত করছে!
আসুন না, আমাদের ঘরে চলুন না। আপনারাও তো এই হোটেলে এসেই উঠেছেন? লেডি মিত্র তাঁর ঘরে আমন্ত্রণ জানালেন।
হ্যাঁ। আজ থাক মিসেস মিত্র, রাত হয়েছে। কিরীটী মৃদু প্রতিবাদ জানায়।
রাত আর এমন বেশী কি হয়েছে? লেডি মিত্র তাঁর সুডোল মণিবন্ধ চোখের সামনে তুলে ধরে দামী রিস্টওয়াচটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তো সবে রাত পৌনে দশটা। আসুন আসুন, তিন-চার দিন হল এই হোটেলটায় এসে উঠেছি, তা একটা লোক পেলাম না যার সঙ্গে দু-দণ্ড আলাপ করা যেতে পারে। ও হোটেলটায় জায়গা পেলাম না, তাই কতকটা বাধ্য হয়েই এসে এই হোটেলটায় উঠতে হল। এত ভাল ভাল সী-সাইড থাকতে কেন যে রাণুর এই হতচ্ছাড়া নাস্টি জায়গাটাতে আসবার জন্যেই এত জেদ চাপল! আসুন মিঃ রায়, মিঃ সুব্রত, আপনিও আসুন।
তরল পানীয়ের প্রভাবে পেটের মধ্যে তখন আমার ক্ষুধার প্রচণ্ড আলোড়ন চলেছে। বাধা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিরীটীকে মিসেস মিত্রকে অনুসরণ করতে দেখে একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমাকেও ওঁদের পশ্চাতে অনুসরণ করতে হল।
হোটেলের দোতলায় কোণের একটু বড় ঘর নিয়ে মাতা ও পুত্রী আছেন। এবং সঙ্গে এসেছে ওঁদের একজন বয়, একজন আয়া ও একজন দাই। এও দেখলাম ঘরে প্রবেশ করে যে, হোটেলের আসবাবপত্রের উপরেই ওঁরা একবারে নির্ভর করেননি, কিছু কিছু শয্যাদ্রব্য ও অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসপত্র যা হয়তা তাঁরা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিলেন, তারই সাহায্যে নিজেদের বাসের কক্ষটি যথাসাধ্য রুচিসম্মতভাবে সাজিয়েগুছিয়ে নিয়েছেন। ধনের প্রাচুর্য ও আভিজাত্যের চিহ্ন সর্বত্রই ঘরের মধ্যে পরিস্ফুট।
ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে লেডি মিত্র বললেন, আসুন। May I offer you a drink Mr. Roy? লেডি মিত্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
No, thanks! Just now we had one!
What about you Mr. Subrata Roy? এবারে আমার প্রতি প্রশ্ন বর্ষিত হল।
No, thanks!
বেশ, ড্রিঙ্ক না চান, চা-কোকো-কফি অর ওভালটিন?
বুঝলাম লেডি মিত্র নাছোড়বান্দা। অতিথিদের অন্ততঃ কিছু না পান করিয়ে সুস্থির হতে পারছেন না।
বেশ, তাহলে চা আনতে বলুন। কিরীটী জবাব দেয়।
বয়, চা লাও। বয়কে চায়ের আদেশ দিয়ে সোফাটার উপরে নিজে একটু ভাল করে গুছিয়ে বসে লেডি মিত্র আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসে বসে আলাপ করবার সময় কোন একটা ডিঙ্ক সঙ্গে না থাকলে আমি চিরদিনই যেন কেমন bored feel করি। আমার বহুদিনকার habit। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, রাণু, দাঁড়িয়ে আছ কেন, বোসো!
রাণু এতক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়েই ছিল, মায়ের আদেশ পেয়ে আমাদেরই পাশের খালি চেয়ারটার ওপরে উপবেশন করল।
আমার only child এই, মিঃ রায়। লরেটো থেকে এবার সিনিয়ার কেমব্রীজ পাস করেছে। Oh dear, রণেনের ইচ্ছে ছিল রাণু বিলেত যায়, ওকে তার ব্যারিস্টারি পড়াবার কী ইচ্ছেই ছিল! But where is he now? সব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দেখুন না—how cruel! আবার কণ্ঠস্বর তাঁর অশ্রুতে গদগদ হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কিরীটী কথার মোড়টা পালটে দিল।