শেষের দিকে কৃষ্ণার কণ্ঠস্বরে সুস্পষ্ট উম্মার ভাব একটা যেন জেগে ওঠে।
কৃষ্ণা যে রীতিমত চঞ্চল ও উত্তেজিত হয়ে উঠেছে বুঝতে কষ্ট হয় না।
মুহূর্তে সমগ্র পরিস্থিতিটাই বুঝে নেন খোদাবক্স এবং এবারে কতকটা যেন কর্তৃত্বভরা কণ্ঠেই বলে ওঠেন, দেখুন মিস্ চৌধুরী, আমি পুলিসের লোক–
খোদবক্সের কথাটা শেষ হলো না।
দিদি! হঠাৎ ঠিক অনুরূপ একটি মেয়েলী কণ্ঠস্বরে খোদাবক্স চমকে মুখ তুলে তাকাতেই সম্মুখে দেওয়ালে প্রলম্বিত দর্পণে দেখতে পেলেন, প্রতিবিম্বিত হয়েছে বর্তমানে তার সম্মুখে উপবিষ্ট অনুরূপ একটি তরুণীরই যেন প্রতিচ্ছায়া।
খোদাবক্স যেন সহসা নিশুপ হয়ে গিয়েছেন। আর্শির বক্ষে দৃষ্টি তখনও তার স্থিরনিবন্ধ।
আশ্চর্য! আশ্চর্য! হুবহু এক! তিলমাত্র প্রভেদ বা পার্থক্যও যেন জীবিত ও আর্শিতে প্রতিফলিত ছায়াতরুণীর মধ্যে কোথাও নেই! অবিকল প্রতিচ্ছবি যেন একে অন্যের!
চক্ষু, নাসিকা, ভূ, কপাল, চিবুক, ওষ্ঠ—এমন কি বাম গালের উপরে ছোট্ট কালো তিলটি পর্যন্ত। দাঁড়াবার বিশেষ ভঙ্গীটি যেন হুবহু এক দুজনারই। এবং সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর কণ্ঠস্বরের মিলটুকুও উভয় তরুণীর একই যেন। কথা বলার ও উচ্চারণ ভঙ্গীটি পর্যন্ত এক।
কে উনি? বিস্মিত হতভম্ব খোদাবক্স এতক্ষণে সম্মুখে সোফার উপরে উপবিষ্ট কৃষ্ণাকে প্রশ্নটা করেন।
দর্পণে প্রতিবিম্বিতা নারী ধীরপদে ততক্ষণ কক্ষে প্রবেশ করে একই সোফার উপরে কৃষ্ণার পার্শ্বে এসে উপবেশন করল।
আমার বোন কাবেরী। কৃষ্ণা জবাব দেয়।
আপনার বোন! আপনারা—
আমরা যমজ বোন, মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের ছোট বড়।
কৃষ্ণা ও কাবেরী যমজ বোন!
পাশাপাশি দুটি বোন কৃষ্ণা কাবেরী সোফার উপরে বসে। পরিধানে শাড়ির রঙ, পাড় এবং পরবার স্টাইলটির মধ্যেও যেন বিন্দুমাত্র পার্থক্য নেই। দুজনেরই মাথার চুল ভোলা। সাধ্য নেই কারো একটি ভগ্নীকে অন্যের থেকে পৃথক করে বুঝবার।
ক্রমে বিস্ময়ের ধাক্কাটা কেটে গেলে ধীর সংযত কণ্ঠে খোদাবক্স এবারে কাবেরীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনার নাম কাবেরী চৌধুরী?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি–
আমি পার্ক সার্কাস থানা থেকে আসছি। আমার নাম খোদাবক্স। আচ্ছা কাবেরী দেবী, আজকের সংবাদপত্রে—বলতে বলতে সংবাদপত্রটি তুলে নরেন মল্লিকের মৃত্যুসংবাদটির প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করে বললেন, এঁকে আপনি চিনতেন?
কথাটা কাবেরীকে জিজ্ঞাসা করা হলেও জবাবটা দিল কৃষ্ণা অনুচ্চ বিরক্তির সুরে, ওর বেলাতেও ঐ কথাই প্রযোজ্য মিঃ খোদাবক্স। বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ওরও তাঁর সঙ্গে ছিল না। আমারই মত সামান্য পরিচয় ছিল মাত্র।
দেখুন কৃষ্ণা দেবী, এবারে সুস্পষ্ট একটা আদেশের কাঠিন্য যেন প্রকাশ পায় খোদাবক্সের কণ্ঠস্বরে, কথাটা আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি, হয়েছে আপনার বোন কাবেরী দেবীকে। উনি শিশু নন—ওঁর যা বলবার ওঁর মুখে শুনতে পেলেই আমি খুশী হবো।
কাবেরী কৃষ্ণার মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল, এবার খোদবক্সের মুখের দিকে তাকাল।
বলুন কাবেরী দেবী, আমার প্রশ্নের জবাব দিন।
সামান্য পরিচয় ছিল মিঃ মল্লিকের সঙ্গে। দু-একবার পার্টিতে, উৎসবে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে মাত্র এই হ্যাঁ। জবাব দিল কাবেরী।
আপনি নরেন মল্লিকের ওখানে মাঝে মাঝে যেতেন?
না। কৃষ্ণার মুখের দিকেই তাকিয়ে কাবেরী এবারে জবাব দিল।
ব্যাপারটা খোদবক্সের দৃষ্টিতে কিন্তু এড়ায় না।
আপনি, কৃষ্ণা দেবী?
কস্মিনকালেও যাইনি।
হুঁ। সত্যিই খোদাবক্স এবার নিজেকে যেন যথেষ্ট বিব্রত বোধ করেন।
বুঝতে তার কষ্ট হয় না, যমজ দুটি বোন কৃষ্ণা ও কাবেরীর মধ্যে নিশ্চয়ই একজন মিথ্যা বলছে এবং দ্বিতীয়জন ইচ্ছা করেই অন্যজনের কথায় সায় দিচ্ছে। এবং এও ঠিক, অবিকল একই রকম দুজনে দেখতে, এদের মধ্যে কে যে মিথ্যা বলছে, নিজে হতে স্বেচ্ছায় এরা স্বীকৃতি না দিলে সেই আসল সত্যটুকু জানা কারো পক্ষে শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভবও। কিন্তু উপায়ই বা কি? যারা এদের মধ্যে একজনকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে দেখেছে তারাও হয়ত এখন দুজনকে পাশাপাশি দেখলে আসলটিকে নির্দিষ্ট করতে পারবে না।
আচ্ছা কৃষ্ণা দেবী, গত রবিবার রাত্রে অর্থাৎ পরশু রাত্রে আপনি সন্ধ্যা হতে রাত্রিতে শয্যায় শয়ন করতে যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত কোথায় ছিলেন বা কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, I mean all your movements and whereabouts in details, একটা বিবৃতি চাই।
এটা কি আপনার জুলুম নয় দারোগা সাহেব?
দেখুন কৃষ্ণা দেবী, আমি যদি তার উত্তরে বলি, নরেন মল্লিকের হত্যার ব্যাপারে আপনারা যমজ ভগ্নী দুজন যথেষ্ট সন্দেহের কারণ ঘটিয়েছেন, মানে—কথাটা খোদবক্সের শেষ হলো না, যুগপৎকৃষ্ণা ও কাবেরী অস্ফুটকণ্ঠে আর্তনাদ করে ওঠে।
অতএব বুঝতেই পারছেন-I want a detail report of the movements of both of you. আপনাদের দুই ভগ্নীরই একটা পূর্ণ জবানবন্দী আমার চাই। এটা আমি দাবী জানাচ্ছি আইনের দিক হতে
এরপর উভয়েই কিছুক্ষণ ঝিম্ দিয়ে থাকে, তারপর কৃষ্ণাই প্রথমে কথা বলে, সেদিন আমাদের দু বোনেরই off duty ছিল।
Off duty ছিল—আপনাদের? মানে, আপনারা কি—
আমরা দু বোনেই টেলিফোন অফিসে চাকরি করি।
ওঃ! আচ্ছা বলুন।