বুঝেছি। নন্দুয়া একটু দূরে সরে দাঁড়ায়।
কলিং বেল টিপতেই একটু পরে দরজা খুলে গেল।
খোলা দরজাপথে এসে দাঁড়াল একটি ২৩।২৪ বৎসরের তরুণী। তরুণীর রূপের সত্যিই যেন অবধি নেই। চাপা ফুলের মত উজ্জ্বল গায়ের বর্ণ। ক্ষীণাঙ্গী নয়, সুডৌল স্বাস্থ্যে দেহযমুনায় যেন বান ডেকেছে। অপরূপ মুখশ্রী। টানা টানা গভীর কৃষ্ণ দুটি আঁখি। ভারী আঁখিপল্লব। নাকের পাশ দিয়ে বামদিককার গালে একটি ছোট্ট কালো তিল। তিলটি সৌন্দর্যকে যেন তিলাঞ্জলি দিচ্ছে। দাঁড়াবার ভঙ্গীটিও অপূর্ব, পুরাকালে রাজসভায় করঙ্ক বাহিনীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। অপর্যাপ্ত কুঞ্চিত কেশরাশি পৃষ্ঠব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। কবির ভাষায় বলতে সাধ যায়, বিকীর্ণ কুন্তলা।
চকিতে অদূরে দণ্ডায়মান নন্দুয়ার দিকে তাকাতেই, নিঃশব্দে ঘাড় হেলিয়ে সে জানাল, হাঁ ঐ মেয়েটিই।
ইশারা করলেন খোদাবক্স নন্দুয়াকে সরে যেতে। নন্দুয়া সরে গেল।
কাকে চান? তরুণীই কথা বললে প্রথমে খোদাবক্সকে সম্বোধন করে।
নমস্কার।
নমস্কার।-তরুণীও প্রতিনমস্কার দেয়।
আমি পার্ক সার্কাস থানার O.C., বিশেষ একটি জরুরী ব্যাপারে আপনাকে একটু বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে বিশেষ দুঃখিত। ঘরে আসতে পারি কি?
তরুণী ভ্রূকুঞ্চিত করে মৃদু কণ্ঠে বলে, আসুন।
তরুণী রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়, খোদাবক্স কক্ষে প্রবেশ করেন।
শৌখীন পরিচ্ছন্ন ভাবে সাজানো-গোছানো ছোট একখানি ঘর। আসবাবপত্র ও ব্যবস্থা দেখে মনে হয় ড্রয়িংরুম হিসাবেই ঘরটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে সাধারণত। গোটা দুই সোফা। ঘরের মেঝেতে কার্পেট বিস্তৃত, মাঝখানে একটি গোল পিতলের স্ট্যাণ্ডে একটি জয়পুরী কারুকার্যখচিত পাত্রে একগোছা প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। ঘরের দেওয়ালে দু-তিনটি ফটোগ্রাফ, দুটি ল্যাণ্ডস্কেপ, কোন একটি বিলাতী কোম্পানীর সুদৃশ্য একখানা দেয়ালপঞ্জী।
ঘরের তিনটি জানলার প্রত্যেকটিতেই সুদৃশ্য জারাণী রঙের পর্দা খাটানো। দ্বিতীয় দরজাটিতে একটা ভারী সবুজবর্ণের পর্দা ঝুলছে। সেই দরজারই ঠিক বিপরীত দেওয়ালে একটি প্রমাণ সাইজের দর্পণ প্রলম্বিত।
সোফাটা দেখিয়ে তরুণী বললে, বসুন।
হঠাৎ এমন সময় কানে ভেসে এলো অন্তরাল হতে অতি শুদ্ধ, সুস্পষ্ট সু-উচ্চারিত ইংরাজীতে আবৃত্তির সুর—
The mind is its own place, and in itself
Can make a Heaven of Hell, a Hell of Heaven.
অন্তরাল হতে যেন সুললিত আবৃত্তির সেই সুর সহসা খোদাবক্সকে আকর্ষণ করে।
বাঃ চমৎকার!
আবার শোনা গেল : এবারে ইংরাজী নয়, বাংলায় আবৃত্তি, কবিগুরুর বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পংক্তি–
তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে
অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে
দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে
শান্তি সমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে।
আবৃত্তি করছেন মনে হচ্ছে এই ফ্ল্যাটেরই যেন কেউ?
হ্যাঁ, আমার বাবা।
আপনার বাবার নামটা জানতে পারি কি?
শ্ৰীসঞ্জীব চৌধুরী। একটা পা ওঁর paralytic হয়ে যাওয়ায় ঘর থেকে বের হতে পারেন না, তাই সর্বদা লেখাপড়া ও আবৃত্তি নিয়েই থাকেন।
একেবারেই হাঁটা-চলা করতে পারেন না বুঝি?
সেই রকমই প্রায়, অতি কষ্টে ক্রাচে ভর দিয়ে সামান্য একটু-আধটু হাঁটা-চলা যা করেন। তরুণী বলে।
দেখেছেন মিস চৌধুরী, আমরা পুলিসের লোকেরা এত unsocial, এতক্ষণ আপনার নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করিনি!
আমার নাম কৃষ্ণা চৌধুরী।
সহসা এমন সময় খোদাবক্সের নজরে পড়ল, অদূরে সোফার উপরে ঐদিনকারই প্রাত্যহিক সুপ্রভাতখানা। এবং মাঝের পৃষ্ঠা—যেটিতে মৃত নরেন মল্লিকের ছবি দিয়ে তার হত্যাসংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, সেটিই খোলা। সংবাদপত্রটার প্রতি কৃষ্ণার দৃষ্টি আকর্ষণ করে খোদাবক্স বলে ওঠেন, পড়েছেন নরেন মল্লিকের হত্যার সংবাদ?
ঈষৎ বিরক্তিমিশ্রিত কণ্ঠে কৃষ্ণা যেন জবাব দেয়, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত একটি শব্দে, হুঁ।
ওঁকে তো আপনি চিনতেন কৃষ্ণা দেবী, তাই না?
ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকায় কৃষ্ণা খোদাবক্সের মুখের দিকে, কে বলেছে একথা?
বুঝতেই পারছেন জানতে পেরেছি, নইলে—মৃদু হাসি ওষ্ঠপ্রান্তে জেগে ওঠে খোদবক্সের অতঃপর।
কৃষ্ণা চুপ করে থাকে, মনে হয় সে যেন একটু অন্যমনস্ক।
শুধু যে চিনতেনই আপনি নরেন মল্লিককে তা নয়, বিশেষ ভাবে জানা গিয়েছে আপনি ওঁর সঙ্গে নাকি বেশ ঘনিষ্ঠ ভাবেই পরিচিত ছিলেন—অবিশ্যি—খোদাবক্স কথাটা শেষ না করে কৃষ্ণার মুখের দিকে তাকালেন।
অস্বীকার করবো না যে তার সঙ্গে সামান্য আলাপ ছিল, তবে আপনি যেরকম ঘনিষ্ঠতার কথা বলছেন—
দেখুন মিস চৌধুরী, পুলিসের লোক আমরা, ভাল ভাবে কোন সংবাদ না নিয়ে
দারোগা সাহেব, ভদ্রতার সীমাটা কি লঙ্ঘন করে যাচ্ছেন না? এখন মনে হচ্ছে, বোধ হয় ঐ কারণেই এখানে আপনার পদার্পণ হয়েছে। সত্যিই যদি তাই হয়ে থাকে, I must say you would be rather disapointed.
খোদবক্সের বুঝতে কষ্ট হয় না, শক্ত মাটিতে পা ফেলেছেন। তাই এবার নিজেকে বেশ প্রস্তুত করেই খোদাবক্স তার বক্তব্য শুরু করেন, কথাটা মানে আপনি যে বিশেষ ভাবেই মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন, মিথ্যে বলেই কি একেবারে উড়িয়ে দিতে চান মিস্ চৌধুরী?
নিশ্চয়। কারণ যেটা সত্যিই মিথ্যা তাকে আইনের দোহাই পেড়ে বা গলাবাজীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে করা যায় না কোন দিনই, আপনার মত একজন আইনজ্ঞকে সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না আশা করি দারোগা সাহেব। তাছাড়া আপনার এ ধরনের প্রশ্ন—not only objectionable, damaging too.