সুবিমল রানা : গত রাত্রে প্রায় সোয়া একটার সময় বাড়ি ফিরেছি। দারোয়ান গেট খুলে দিয়েছিল, মধু ভিতরের দরজা খুলে দেয়। হ্যাঁ, লক্ষ্য করেছি মামাবাবুর ঘরের আলো তখনও জ্বলছিল, আমার বেশ স্পষ্টই মনে আছে। গতকাল সকাল নটায় অফিসের জরুরী কাজে ডায়মণ্ডহারবার যখন যাচ্ছি, মামার সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ হয়। না, মামার হাবভাবে বা কথাবার্তায় এমন কিছুই বুঝিনি যাতে করে কোন বিপদ আসছে বলে সন্দেহ মনে জাগতে পারে। না, তাঁর বন্ধু-বান্ধবীদের সম্পর্কে আমি কিছুই তেমন জানি না। মাস আষ্টেক হবে মামার একান্ত অনুরোধেই এখানে এসে আছি। আমার সংসারে আপনার বলতে একমাত্র বিধবা মা, এখনো তিনি বেঁচে আছেন, কুড়িগ্রামে দেশের বাড়িতেই আছেন। মা ও মামাবাবু বৈমাত্রেয় ভাই বোন। না, মামার কোন উইল আছে কিনা সে সম্পর্কে কিছুই আমি জানি না। না, আজ পর্যন্ত উইল সম্পর্কে কোন কৌতূহলও আমার মনে দেখা দেয়নি। ভারত বন্ধু বীমা কোম্পানীতে বছর দুই হলো চাকরি করছি। ফিক্সড তিনশত টাকা মাইনেতে আমি সেখানে এজেন্সী করি। আজ্ঞে না, বিবাহ করিনি, কারণ তেমন যে বিশেষ কিছু আছে তা নয়। প্রথম। কথা, যোগাযোগ তেমন কিছু ঘটেনি, আর আমার মতে আজকালকার দিনে ঐ সামান্য আয়ে বিবাহ করাটা খুব সুবিবেচকের কাজও নয়!
হঠাৎ ইল্সপেক্টার প্রশ্ন করলেন, সুবিমলবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো—ইদানীং শোনা যাচ্ছে আপনার মামা নরেন মল্লিক নাকি একটি সুন্দরী তরুণীর সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, ও সম্পর্কে আপনি কিছু জানেন বা কোনরকম—
জানি বললে ভুল হবে। তবে হ্যাঁ, দু-একবার একটি সুন্দরী তরুণীকে মামাবাবুর সঙ্গে দেখেছি। একবার নটার শোতে রক্সি সিনেমায় আর বার দুই হ মার্কেটে–
তার নাম শুনেছেন কখনো?
না।
আচ্ছা আপনার মামা বিবাহ করবেন বা করবার কোন মনস্থ করেছেন এ সম্পর্কে কোন কিছু আপনি আপনার মামার মুখে শুনেছেন বা—
না, তেমন কোন আভাসই পাইনি। তাছাড়া মামার এখানে আমি একান্ত অনুরোধেই এসে থাকি বটে, তার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ কচিৎ কখনো হতো। আমি সর্বদাই আমার কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকি।
হুঁ। আচ্ছা যে সুন্দরী মেয়েটির কথা বললেন, তাকে কখনো রাত্রে এ বাড়িতে দেখেছেন?
না। কথাটা যেন একটু ইতস্তত করেই উচ্চারণ করে সুবিমল।
মেয়েটিকে দেখলে চিনতে পারবেন নিশ্চয়ই!
আশা তো করি।
বিনতা দেবী : নরেন মল্লিক নতুন বাড়িতে আসবার মাসখানেক বাদেই বিনতা দেবী এখানে এসে চাকরিতে ঢোকেন। একজন স্ত্রীলোক না হলে সংসারের কাজ ভালভাবে চলে না বলে ভদ্রঘরের একজন দুঃস্থ মহিলার জন্য নরেন মল্লিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। সেই বিজ্ঞাপন অনুযায়ী বিনতা দরখাস্ত করায় বিনতাকে নরেন মল্লিক কাজে বহাল করেন। বিনতা বিধবা, বর্ষীয়সী, ভদ্রঘরের। বিনতা এসে কাজে ঢোকবার পর ধীরে ধীরে একটু একটু করে সংসারের আভ্যন্তরিক ব্যবস্থাটা তারই হাতের মধ্যে চলে যায়। অত্যন্ত শান্ত ও মৃদুভাষী। কথা একটা প্রয়োজন ছাড়া কারো সঙ্গে তাকে বলতেই কখনো দেখা যায়নি। সংসারের আভ্যন্তরীণ খরচাদির টাকাকড়িও মাসের প্রথমেই মধুর হাত দিয়ে বরাবর নরেন মল্লিক বিনতার হাতেই পাঠিয়ে দিতেন। নিচের তলায় একটা ঘরে একাকিনী থাকতেন বিনতা, মাথার উপরে সর্বদা দীর্ঘ গুণ্ঠন থাকতো টানা। এ বাড়িতেও কেউ কখনো তার মুখ দেখেছে বলে মনে পড়ে না। নরেন মল্লিকের সকল ব্যাপারে সর্বদা বিনতার দুটি চক্ষু সজাগ থাকলেও গত ৮৯ মাসের মধ্যে কখনো তাকে কেউ নরেন মল্লিকের ঘরে বা তার সঙ্গে কথা বলতে সামনাসামনি দেখেনি। উভয়ের যাবতীয় কথাবার্তা মধুর মারফতই হতো। সেই বিনতাকে যখন ডাকা হলো, তিনি বললেন, ঘটনার দিন দ্বিপ্রহর থেকেই মাথায় যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে বিকাল থেকে তার নিজের ঘরের মধ্যেই ছিলেন। রাত্রে নরেন মল্লিক গৃহে প্রত্যাবর্তনের পর মাত্র দুই মিনিটের জন্য ঘর থেকে বের হয়ে মধুকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন নরেন মল্লিক রাত্রে কি আহার করবেন সেটা জানার জন্য। এবং মধুর মুখে রাত্রে তিনি আহার করবেন না জেনে আবার ঘরে গিয়ে ঢোকেন। পরের দিন সকালে ভৃত্যদের গোলমালে ঘুম ভেঙ্গে বাইরে এসে মধুর মুখেই সব ব্যাপারটা শোনেন। নরেন মল্লিক সম্পর্কে কোন কথাই বলতে পারলেন না তিনি। যে সুন্দরী তরুণীটি ইদানীং কিছুদিন ধরে নরেন মল্লিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল এবং মধ্যে মধ্যে এ বাড়িতে আসততা তার গলাই এক-আধবার বিনতা শুনেছেন কিন্তু কখনো তাকে চাক্ষুষ দেখেননি বা তাকে দেখলেও চিনতে পারবেন না।
সেই সুন্দরী মেয়েটি!
প্রায় প্রত্যেকেরই জবানবন্দী থেকে মৃত নরেন মল্লিকের সঙ্গে যে সুন্দরী তরুণীর ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে শোনা গেল, সেই মেয়েটিরই খোঁজে পরের দিন পার্ক সার্কাস থানার ইনচার্জ খোদাবক্স। নরেনের ড্রাইভার নন্দুয়াকে সঙ্গে করে আমীর আলী য়্যাভিনুর ত্রিতল একটি ফ্ল্যাট বাড়ির তিনতলার ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলেন। দরজা ভিতর হতে বন্ধ। দরজার গায়ে কলিং বেলের ব্যবস্থা আছে দেখা গেল।
নন্দুয়া, তুমি একটু আড়ালে দাঁড়াও, মেয়েটিই যদি এসে দরজা খুলে দেয় তো আমাকে চোখ-ইশারায় কেবল তুমি জানিয়ে দেবে।