তাঁরই শয়নকক্ষে বুক-শেলয়ের উপরে একটা সুদৃশ্য জয়পুরী পিতলের প্লেটে ছোরাটা থাকত এবং অনেকেই সে কথা জানত। ছোরাটা তাকে উপহার দিয়েছিল তারই এক বন্ধু, মহীশূরে বেড়াতে গিয়ে কিনে এনে তারই কোন এক জন্মতিথি উৎসব উপলক্ষে।
মধু ঘোষ, গোয়ালার ছেলে, বাড়ি কাটোয়ায়। বছর আষ্টেক হবে নরেন মল্লিকের সঙ্গে আছে। নরেনের বেশীর ভাগ কাজ ও-ই করত। নরেনের জামা কাপড় ইত্যাদির ভারও মধুর উপরেই ছিল। নরেন ওকে অত্যন্ত ভালবাসতেন : লিখে চলেন খোদাবক্স।
মধু তার জবানবন্দীতে আরো বলে :
ইদানীং একটি মেয়ে বাবুর সঙ্গে একটু যেন বেশী ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। বয়স তার বছর ২৪/২৫ হবে। দেখতে খুব সুন্দরী না, তার বাড়ির ঠিকানা আমি জানি না, ড্রাইভার নন্দুয়া হয়ত জানে। দেখলে হ্যাঁ, তাকে দেখলে নিশ্চয়ই আমি চিনতে পারবো, অনেক দিন তো তাকে। দেখেছি। আজ্ঞে মেয়েটি খুব ভাল বলেই তো মনে হয়। বাবুর ভাগ্নে ঐ সুবিমলবাবুকে বাবু খুব ভালবাসতেন। সুবিমলবাবুও তার মামাবাবুকে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা করতেন। না, মামা-ভাগ্নের মধ্যে কোন মন-কষাকষি বা রাগারাগিই ছিল না। কাল সুবিমলবাবু অনেক রাত্রে বাড়ি ফিরেছেন, নিচের দালানের দরজা রাত্রে আমিই তাকে খুলে দিয়েছিলাম। না, বাবুর শত্রু থাকলেও সে খবর আমি রাখি না বাবু। অমন লোকের কোন শত্রু থাকতে পারে বিশ্বাস করি না। না, কাউকেই আমার সন্দেহ হয় না। না, কোন শব্দ বা চিৎকার আমি শুনি নি গতরাত্রে।
যদুনাথ পোল : আজ্ঞে–জাতিতে আমি সদ্গোপ। বাড়ি পাবনা জেলায়। মাস ছয়েক হলো বাবুর এখানে কাজে বহাল হয়েছি। সেদিন উৎসব শেষে সকলে চলে গেলে কিছুক্ষণ পরেই জামা কাপড় বদলিয়ে বাবু গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলেন। রাত্রি দশটায় আবার ফিরে আসেন। আজ্ঞে না, কোন শব্দই ঐ রাত্রে আমি শুনতে পাই নি। খাটাখাটনিতে বড্ড পরিশ্রান্ত ছিলাম, শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। পরের দিন মধুদার ডাকেই ঘুম ভেঙ্গে সব শুনতে পাই।
হরি সাধুঃ আমি বাবু জাতিতে তিলি, বাড়ি বগুড়া জেলায়। মাস তিনেক হলো বাবুর এখানে কাজ করছি। বাবু বেশ ঠাণ্ডামেজাজী লোক ছিলেন, কখনো কাউকেই গালমন্দ করতেন না। সন্ধ্যার ঝামেলা মিটে গেলে বাবুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে, আমার এক খুড়ো থাকে পার্ক সার্কাস বাজারের ওপরে, তার পানবিড়ির দোকান, তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসেছি রাত যখন সাড়ে বারোটা হবে, দারোয়ানের ঘরের ঘড়িতেই সময় দেখেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে বাবুর শোবার ঘরের আলো তখনও জ্বলছিল। আজ্ঞে না, কোন চিৎকার বা শব্দ কিছুই শুনতে পাই নি। সকালে মধুদার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙ্গে, তার মুখেই প্রথমে শুনলাম বাবু খুন হয়েছেন।
রামখেল সিং : বাড়ি ছাপড়া জিলায়, এ বাড়িতে শুরু থেকেই আমি দারোয়ানের কাজ করছি। আজ্ঞে হ্যাঁ, রাত্রি সাড়ে দশটার পরই সাধারণত গেট বন্ধ করে দিই। রাত যখন সাড়ে এগারোটা, নন্দুয়া এসে বিড়ি চাওয়ায় তাকে বিড়ি দিই, ঐ সময়ই বাবুর ঘরের আলো নিবে যেতে দেখি। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঘরে আমার একটা ঘড়ি আছে, বাবুই কিনে দিয়েছিলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, রাত সাড়ে বারোটায় হরি ফিরে এলে আবার তাকে গেট খুলে দিই, আবার রাত সোয়া একটায় সুবিমলবাবুও ফিরে এলে গেট খুলে দিয়েছিলাম। না, শেষের দুবারের একবারও তখন বাবুর ঘরের আলো জ্বলছিল কিনা লক্ষ্য করি নি, তবে যতদূর মনে পড়ে জ্বলছিল না।
রামভজন সিং ও সন্ধ্যার পরই ছুটি নিয়ে টালায় তার এক দেশওয়ালী ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যায়, ফিরেছে আজ সকাল বেলা সাড়ে নটায়। এখানে মাস পাঁচেক মাত্র চাকরি করছে।
ঠাকুর জগন্নাথ : বাড়ি উড়িষ্যায়। রান্নাঘরের পাশেই ছোট একটা ঘরে আমি শুই। উৎসবের ঝামেলা মিটে গেলে এবং বাবু রাত্রে কিছু আর খাবেন না শুনে শুয়ে পড়ি, বড্ড মাথা ধরেছিল বলে, কিছু জানি না, কোন চিৎকার বা শব্দও শুনি নি। পরদিন মধুদার ডাকে ঘুম ভাঙ্গে এবং তার মুখেই প্রথমে শুনি বাবু খুন হয়েছেন।
নন্দুয়া : বাড়ি মজঃফরপুর। মাস আষ্টেক হবে বাবুর গাড়ির ড্রাইভারি করছি আমি। বাবু বেশীর ভাগই দেশপ্রিয় পার্কে বা লেকেই সন্ধ্যার দিকে বেড়াতে যেতেন। ইদানীং মাস কয়েক আমীর আলী য়্যাভিনুতে ছোট একটা পার্কেও মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে গিয়ে তিনি বসতেন। সেখানে একটি খুব সুন্দরী মেয়ে, বয়স ২৫/২৬ হবে, বাবুর সঙ্গে বসে গল্প করতো দেখেছি, মাঝে মাঝে সেই দিদিমণিকে নিয়ে বাবু লেকে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে হগ মার্কেটে এবং মাঝে মাঝে রাত্রের শোতে সিনেমাতেও যেতেন। গতকাল রাত্রে দেশপ্রিয় পার্কে যান—ফিরে আসবার সময় সেই দিদিমণিকে পার্কের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে দেখেছি। বাবুকে তারপর সোজা একাই গাড়িতে করে বাড়ি নিয়ে আসি। না, দেখিনি দিদিমণি কোন্ দিকে গেলেন। হ্যাঁ, দিদিমণির বাড়ি চিনি। দু-একবার তাকে চিঠিও দিয়ে এসেছি। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তাকে দেখলেই চিনতে পারবো। হ্যাঁ, রাত সাড়ে এগারোটায় বিড়ি ফুরিয়ে যেতে দারোয়ানের কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে এনেছিলাম। হ্যাঁ, আমিও দেখেছি ঐসময় বাবুর ঘরের আলো নিবে যায়। না, রাত্রে কোন চিৎকার বা শব্দ শুনি নি। না, কোন রকম সন্দেহজনক কিছু দেখি নি, তবে আগে, মানে মাসখানেক আগে পর্যন্তও প্রায়ই দেখতাম একটা কালো রংয়ের সিডনবডি গাড়ি যেন আমাদের গাড়ির পিছু পিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে গেটের সামনে এগিয়ে যেতে দেখেই গাড়িটা ছেড়ে চলে যায়। না, গাড়ির নম্বরটা কখনো দেখতে পাই নি। হ্যাঁ, বাবুকে বলেছিলাম—বাবু বলেছিলেন, ও কিছু না। কে আবার আমাদের গাড়িকে follow করবে?