গভীর রাত্রি। গ্র্যাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড। ঝড়ের বেগে কিরীটীর গাড়ি ছুটে চলেছে। ড্যাসবোর্ডের নীলাভ আলোয় দেখা যায় স্পিডোমিটারের নিডল্টা কাঁপছে—৬০-৬৫, ৬০-৬৫! এগিয়ে চলে ঝড়ের বেগে নির্জন রাস্তা ধরে জীপটা।
লিলুয়া, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, মাহেশ, শ্রীরামপুর শ্রীরামপুর লেভেলক্রসিং পার হয়ে এলো বদ্যিবাটি। আরো আরো দ্রুত। ব্যাণ্ডেলের স্টেশন ইয়ার্ডের আলো দেখা যাচ্ছে। ঐ—ঐ যে সেই গাড়ি ছুটে চলেছে! টেল ল্যাম্পে দেখা যাচ্ছে নম্বরটা : BLA 6786। উল্লাসে কিরীটীর মন নেচে ওঠে।
অগ্রগামী গাড়ির আরোহীও বোধ হয় বুঝতে পারে একটা গাড়ি তাকে অনুসরণ করছে, গতিবেগ তারও বেড়ে যায়।
কিরীটীও তার গাড়ির গতি আরো বাড়িয়ে দেয় একসিলারেটারে আরো চাপ দিয়ে। স্পিডোমিটারের নিল্টা এবারে কাঁপছে—৬৫-৭০, ৬৫-৭০! সামনের গাড়িটা ছুটছে ঝড়ের গতিতে।
কিরীটীর নির্দেশে রহমান সাহেব হাত বাড়িয়ে আগের গাড়ির পশ্চাতের চাকা লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
দুড়ুম! দুড়ুম!
আগের গাড়িটা এঁকেবেঁকে চলে হঠাৎ মন্দগতিতে। আবার গুলির শব্দ।
হঠাৎ এবার সামনের গাড়িটার পশ্চাতের একটা টায়ার ভীষণ শব্দ করে ফেটে যায়, সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটা একটা গাছের সঙ্গে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে উল্টে গেল।
কিরীটীর গাড়ি এসে থামল উল্টে-যাওয়া গাড়িটার সামনে। গাড়ির আরোহী মৃত। কিরীটী মৃতের বুকপকেট হতে পাসটা টেনে বের করলে এবং পার্সের মধ্যে থেকেই বের হলো বাদামের মত একটা হীরা। অন্ধকারে ঝলমল করে উঠলো হীরাটা।
কিরীটী উত্তেজিত কণ্ঠে রহমান সাহেবকে বললে, এই কমল হীরাটা নরেন মল্লিক বর্মা টী এরই খোঁজে এসেছিল হতভাগ্য ঐ পাঠান ইসমাইলের চর হয়ে, কিন্তু নরেন মল্লিককে হত্যা করেও সে হীরাটা পেল না—ভগবানের মার হাতে-হাতেই পেল। চল এবার ফেরা যাক।
উভয়ে আবার গাড়িতে উঠে বসল। গাড়ি ফিরে চললো কলকাতার দিকে।
.
দিন-দুই পরে। ডাঃ সুকুমার গুপ্তের চেম্বার। ডাক্তার একটা সোফার উপরে আড় হয়ে শুয়ে আপনমনে একখানা ইংরাজি নভেল পড়ছিল। সুইংডোরটা খুলে গেল। ডাক্তার চেয়ে দেখলে ঘরে প্রবেশ করছে কৃষ্ণা।
ডাক্তারের মুখখানা হাসিতে ভরে গেল, মধুর কণ্ঠে আহ্বান জানাল, আরে এসো এসো কৃষ্ণা!
কৃষ্ণা নই তো আমি, আমি কাবেরী!
পাশে এসে দাঁড়ায় ডাক্তার, মৃদু হেসে বলে, তবে প্রশ্নের উত্তর দাও আমার।
কর প্রশ্ন?
Ready!
Ready.
রাত্রি?
উঁহু, এখন সন্ধ্যা—ঠিক সন্ধ্যা।
শুভদৃষ্টি?
যাও। লজ্জায় রক্তিম হয়ে কৃষ্ণা মুখখানা নিচু করে।
যাও বললে চলবে না, জবাব দিতে হবে। সোফা ছেড়ে উঠে কাছে এসে দাঁড়াল সুকুমার কৃষ্ণার মুখোমুখি।
তবু কৃষ্ণা কোন জবাব দেয় না।
ডাক্তার, ওর হয়ে আমি জবাবটা দিচ্ছি শোন!
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চমকে উঠে দুজনেই দরজার দিকে ফিরে তাকায়।
দুহাতে পর্দাটা সরিয়ে দরজার ধারে কেবল পর্দার ফাঁক দিয়ে মুখখানা মাত্র বের করে নিঃশব্দে হাসছে কিরীটী।
আরে কিরীটী! এসো এসো।
না ভাই, হীরাটা সরকারকে ফেরত না দিয়ে যার প্রাপ্য তার হাতেই তুলে দিতে এসেছি। নিন কৃষ্ণা দেবী, নরেনের হয়ে আপনাদের দেয় তার বিবাহের যৌতুকটা আমিই দিয়ে গেলাম।
কৃষ্ণা সলজ্জ কুণ্ঠার সঙ্গে হাত বাড়িয়ে হীরাটা নেয়।
তবে ভাই চলি!
আরে শোন শোন—
না ভাই, কৃষ্ণা দেবীকে তোমার প্রশ্ন শুভদৃষ্টি এবং তার জবাবটা শুনবার অধিকার একমাত্র তোমারই—তাছাড়া জান তো, আমাদের দেশে প্রথা আছে শুভদৃষ্টির সময় চাদর দিয়ে আচ্ছাদন দিতে হয় অন্যের দৃষ্টিকে। হাতের কাছে যখন চাদর নেই, মধুর অভাবে গুড়ং দদ্যাৎ—শাস্ত্রবিধি যখন আছেই, অতএব–
হাসতে হাসতে দুহাতে দরজার পর্দাটা টেনে দিতে যাচ্ছিল, সেই সময় হঠাৎ কৃষ্ণা প্রশ্ন করে, একটা কথা মিঃ রায়, বিনতা দেবীর কোন সংবাদ পেলেন?
কিরীটী কৃষ্ণার দিকে তাকাল, না।
তারপরই কি রকম যেন সন্দেহ হতে সে-ই প্রশ্ন করে, তাঁকে কি আপনি চিনতে পেরেছিলেন কৃষ্ণা দেবী?
হাঁ।
চিনেছিলেন?
হ্যাঁ, শুধু আমিই নয়, বাবাও। বাবা তারই সন্ধানে বের হয়ে গিয়েছেন গত পরশু।
কৃষ্ণা চুপ করল। তার দুচোখের কোলে যেন দুফোঁটা অশ্রু টলমল করছে।