বিনতা দেবী।
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কিরীটী একটানা চিঠিটা পড়ে গেল।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলেই তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিসের ব্যাকুল প্রতীক্ষ্ণয় যেন। তারপর কিরীটী ঘরের সেই জমাট বরফের মত স্তব্ধতা ভঙ্গ করলে, ডাকল, কৃষ্ণা দেবী।
বলুন।
এই চিঠিটা কার জানেন?
কৃষ্ণা কিরীটীর কথার কোন জবাব না দিয়ে কেবল নির্বাক দৃষ্টিতে বারেকের জন্য তাকাল ওর মুখের দিকে। সে দৃষ্টিতে প্রশ্ন বা বিস্ময়, ভয় বা ব্যাকুলতা যেন কিছু নেই। ভাবলেশহীন স্থির পাথুরে দৃষ্টি।
চিঠিটা লিখেছেন বিনতা দেবী। তাঁর পরিচয়টা নিশ্চয়ই নতুন করে আর আপনাকে দিতে হবে না! আপনি তো তাকে ভাল করেই চেনেন, তাই না?
চিনি।
হঠাৎ ঐ সময় সঞ্জীব চৌধুরী ব্যাকুলকণ্ঠে কৃষ্ণাকে প্রশ্ন করলেন, কে-কাকে তুই চিনিস কৃষ্ণা? কার নাম বিনতা?
মিঃ চৌধুরী, আবার আপনাকে এই শেষবারের মত আমি বলছি—হয় আপনি চুপ করে থাকবেন যদি এঘরে থাকতে চান, নচেৎ বাধ্য হবো আমি আপনাকে পাশের ঘরে পাঠিয়ে দিতে!
কিন্তু কেন—কেন বলুন তো মিঃ রায় আপনি এভাবে আমাদের উপরে অত্যাচার করছেন, জুলুম করছেন? আমি তো বলছি বার বার যে আমিই নরেন মল্লিককে হত্যা করেছি। ওরা—কৃষ্ণা কাবেরী কিছুই জানে না। নরেনের প্রতি বহুদিন আগে থাকতেই আমার কোন পারিবারিক ঘটনার জন্য আক্রোশ ছিল, তাই তাকে আমি হত্যা করেছি।
না। সে-সবই আমি জানি মিঃ চৌধুরী, আপনি নরেন মল্লিককে হত্যা করেন নি, করতে পারেন না। কথাটা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলেই কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল আবার কৃষ্ণার দিকে এবং প্রশ্ন করল, কৃষ্ণা দেবী, রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে আপনি নরেন মল্লিকের হত্যার রাত্রে তার বাড়িতে তার শয়নঘরে গিয়েছিলেন? বলুন, মিথ্যে আর সব কিছু গোপন করবার চেষ্টা করবেন না—আমি সব জানি।
হাঁ গিয়েছিলাম।
কোন্ পথ দিয়ে তার শয়নঘরে প্রবেশ করেছিলেন?
বাথরুমের দরজা দিয়ে।
কৃষ্ণা—ওরে হতভাগী কি বলছিস তুই! আবার চেঁচিয়ে উঠলেন সঞ্জীব চৌধুরী যেন সব কিছু ভুলে।
বাধা দিও না বাবা, মিঃ রায় যা জানতে চান—সব আমাকে বলতে দাও। বলে উঠলো এবারে কৃষ্ণাই। এবং তার কণ্ঠস্বরে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞার সুর যেন ঝরে পড়ল এতক্ষণে। কৃষ্ণা বলতে লাগল, হাঁ মিঃ রায়, গিয়েছিলাম সে-রাত্রে আমি নরেন মল্লিকের ঘরে।
কেন—কেন গিয়েছিলেন?
তাঁকে সাবধান করে দিতে গিয়েছিলাম, কাবেরীর সঙ্গে যেন তিনি আর ভবিষ্যতে না মিশবার চেষ্টা করেন।
তারপর দেখা হয়েছিল—কোন কথাবার্তা হয়েছিল তার সঙ্গে?
না।
কোন কথাবার্তাই হয় নি?
না, কারণ ঘরে যখন ঢুকছি দেখি বক্ষে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় তিনি তখন রক্তাক্ত ঘরের মেঝের উপরে পড়ে ছটফট করছেন। তাই দেখেই ভয় পেয়ে তখুনি আমি ছুটে পালাই।
সিঁড়ি দিয়ে আপনি পালিয়েছিলেন?
হাঁ।
সে সময় কারো সঙ্গে সিঁড়িতে আপনার দেখা হয়েছিল বা কাউকে সিঁড়ির নীচে দেখতে পেয়েছিলেন?
কোনদিকেই তখন আমার লক্ষ্য ছিল না, ছুটে পালাতেই তখন আমি ব্যস্ত।
আপনি যখন নরেন মল্লিকের ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, ঘরের মধ্যে আর কাউকে দেখেছিলেন?
না।
ভাল করে ভেবে বলুন!
না, দেখি নি।
আর একটা কথার সত্যি জবাব দেবেন, কৃষ্ণা দেবী?
বলুন।
নরেনের মুখে কখনো দামী জুয়েলস্ বা অন্য জাতীয় কিছুর কথা শুনেছেন?
না।
কাবেরী দেবী, আপনি?
না।
আপনারা ঐজাতীয় কখনো কিছু তার কাছে দেখেছেন?
উভয়েই একসঙ্গে জবাব দিল, না।
ঠিক এই সময় একটি সাধারণ বেশভূষায় সজ্জিত তরুণ যুবক ঘরে এসে প্রবেশ করল।
কিরীটা তার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, কি খবর বিভূতি?
ইনসপেক্টর মিঃ রক্ষিত আমাকে পাঠিয়েছেন একটা কথা বলতে—
বল।
ফৈয়াজ খানের details পাওয়া গেছে। সে বর্মা থেকেই আসছে। এবং মাস দশেক আগে তার বর্মার বাড়ির সেফ থেকে একটা দামী হীরা আশ্চর্যরকমভাবে চুরি যায়, যার সন্ধান বর্মা পুলিস আজও করতে পারে নি। সে আদপেই দালাল নয়।
কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটীর চোখের তারা দুটো যেন কি এক উত্তেজনায় ঝক্ঝক্ করে ওঠে। সে ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, আর কোন সংবাদ বলেছেন?
হ্যাঁ, বলেছেন ফৈয়াজ খানের মুভমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে সে হয়তো দুচার ঘণ্টার মধ্যেই হোটেল ছেড়ে চলে যাবে।
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী রহমানের দিকে তাকিয়ে বললে, আপনার সঙ্গে তো জীপ আছে রহমান সাহেব?
হাঁ।
তাহলে আসুন। কিরীটী দরজার দিকে এগুলো।
কোথায়–কোথায় যাবো?
আঃ, এখন তর্ক করবেন না—আসুন!
একপ্রকার যেন টানতে টানতেই কিরীটী রহমান সাহেবকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বাকী সবাই ঘরের মধ্যে স্তম্ভিত বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে রইল, নির্বাক।
সোজা কিরীটীর গাড়ি তাজ হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। ম্যানেজারকে ডাকতেই সে চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে এলো, কি চান? সিট খালি নেই!
পরক্ষণে পুলিসের পোশাক পরা রহমানকে দেখে একটা ঢোক গিলে ম্যানেজার বললো, ব্যাপার কি?
ফৈয়াজ খাঁ নামে কোন পাঠান এখানে আপনার হোটেলে আছে? কোন্ ঘরে থাকে লোকটা? কিরীটী প্রশ্ন করল।
সে তো এইমাত্র আধ ঘণ্টাটাক হলো হোটেলের বিল চুকিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে বর্ধমান চলে গেল!
বাকী কথাটা আর কিরীটী শেষ করতে দিলে না, আবার রহমানকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নীচে নেমে গেল এবং গিয়ে জীপে উঠে বসল।