না। কেবল শুনেছিলাম এক রাত্রে আগুনে পুড়ে তার মৃত্যু হয়।
আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন মা?
হাঁ। কিন্তু আর দেরি করো না কৃষ্ণারাত অনেক হলো, এবারে বাড়ি যাও।
সে-রাত্রে কৃষ্ণা চলে গেল। কিন্তু বাকী রাতটুকু মুহূর্তের জন্যও চোখের পাতায় আমার ঘুম এলো না।
আমার বক্তব্য শেষ হয়ে এসেছে মিঃ রায়। এবার নরেন মল্লিকের মৃত্যুর কথা বলে এ কাহিনীর উপরে আমি পূর্ণচ্ছেদ টেনে দেবো।
মনে আছে সে তারিখটা, ২৭শে পৌষ সোমবার। নরেনের গৃহে তার জন্মতিথি উৎসব। বিরাট হৈ-চৈ হলো বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। ভিড় কমতে কমতে রাত প্রায় পৌনে আটটা হলো। নরেন উৎসবের পরে বের হয়ে গিয়েছিল। ফিরলো রাত দশটায়। উৎসব-শেষে সমস্ত বাড়িটা যেন অকস্মাৎ একেবারে নিঝুম হয়ে গিয়েছে। উৎসবের খাটুনিতে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে ছিল, নিজের ঘরে শয্যার উপরে আলো নিবিয়ে চোখ বুজে পড়েছিলাম। আপনি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, নরেনের শয়নঘরের ঠিক নীচের ঘরেই আমি থাকতাম। তাই উপরের ঘরের সামান্যতম শব্দও রাত্রে নীচের ঘরে আমার কানে আসতো। রাত তখন বোধ করি সাড়ে এগারটা হবে, হঠাৎ মনে হলো উপরের ঘরে কি যেন একটা ভারী বস্তু মেঝেতে পড়ল। তারপরই একটা দুষ্পাপ পায়ের শব্দ। কি রকম কৌতূহল হলো, তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের হয়ে দোতলার সিঁড়ির দিকে এলাম। সিঁড়ির প্রথম ধাপ পার হয়ে দ্বিতীয় ধাপে উঠেছি, দেখি কে যেন অত্যন্ত দ্রুতপদে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। সিঁড়ির আলোটা রাত্রে নেভানোই থাকত, তাই হয়তো অন্ধকারে সে আমাকে দেখতে পায় নি বা উত্তেজনায় আমার দিকে নজর দেবার ফুরসৎ পায় নি। আমি তাড়াতাড়ি একটু পাশে সরে দাঁড়ালাম। ঝড়ের মতই সে আমার পাশ দিয়ে নেমে, প্যাসেজটা পার হয়ে প্যাসেজের অপর প্রান্তের দরজাটা দিয়ে বাড়ির পিছনের বাগানের দিকে চলে গেল। প্যাসেজের শেষ প্রান্তের আলোয় অপস্রিয়মাণ সেই মূর্তিকে আমার চিনতে কষ্ট হয় নি, সে আমারই মেয়েদের মধ্যে একজন—হয় কৃষ্ণা, না হয় কাবেরী। কিন্তু খানিকটা দূর থেকে তাড়াতাড়ি দেখেছিলাম বলে ঠিক দুজনের মধ্যে কে, কৃষ্ণা না কাবেরী চিনে উঠতে পারি নি। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে সিঁড়ির সেই ধাপে কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপরই সোজা উপরে উঠে গেলাম। নরেনের শোবার ঘরটা হা-হা করছে খোলা। ঘরের মধ্যে জ্বলছে আলো। খোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। একপাশে কাত হয়ে নরেনের দেহটা পড়ে তখনো আক্ষেপ করছে। দুটো হাতই গোটানো। আরো একটু এগিয়ে গিয়ে নরেনের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলাম। একটা ছোরা সমূলে প্রায় বিদ্ধ হয়ে আছে নরেনের বুকের বাঁ দিকে। আর ছোরার বাঁটটা তখনও সে ডানহাতের মুষ্টি দিয়ে ধরে আছে। রক্তে সমস্ত জায়গাটা ভেসে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে নরেনকে চিৎ করে শুইয়ে দিলাম। নরেন একবার মাত্র যেন অতিকষ্টে চোখ মেলে আমার দিকে তাকাল, কি যেন বলবার চেষ্টা করল, সবটা নয়—কেবল বুঝলাম একটি কথা, ক্ষমা। তার পরই একটা হেঁচকি তুলে দেহটা স্থির হয়ে গেল। স্তব্ধ নির্বাক কতক্ষণ যে সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার পরেও মনে নেই।
খেয়াল হতেই দেখি, বাথরুমের দরজাটা হা-হা করছে খোলা। ভয় পেয়ে আর সেখানে না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি আমি সোজা নিজের ঘরে নীচে চলে এলাম। নিজের ঘরে বসে আছি ভূতের মত, বোধ হয় আরো আধ ঘণ্টা পরে আবার উপরের ঘর থেকে ঝঝন্ শব্দ কানে এলো। আবার উপরে গেলাম কিন্তু ভোলা দরজাপথে ঘরের মধ্যে উঁকি দিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আমার স্বামী কাবেরীর হাত ধরে টানতে টানতে তাকে বাথরুমের দরজা দিয়ে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। কাবেরী বাধা দিচ্ছে তাকে যাবে না বলে, আর কৃষ্ণা চাপা গলায় বলছে, চল্ কাবি, শীগগিরি এখান থেকে চশীগগিরি চ।
শেষ পর্যন্ত কোনমতে কৃষ্ণা ও আমার স্বামী কাবেরীকে নিয়ে চলে গেল। একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, প্রথমবারে যখন উপরের ঘরে সেরাত্রে আমি যাই—ঘরে ঢুকবার পরই, বোধ হয় মিনিটখানেক পরেই, একটা গাড়ির শব্দ আমি পেয়েছিলাম। কৌতূহলে জানালাপথে তাকাতে দেখেছিলাম, বাড়ির গেটের সামনে থেকে একটা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। গাড়িটা কালো রংয়ের সিডনবডি। গাড়ির নম্বরটা দেখেছিলাম এবং নম্বরটা আজও আমার মনে আছে, কারণ মধুর মুখে আগে একবার শুনেছিলাম ঐ নম্বরের ঐ গাড়িটাকে নাকি দুএকবার রাত্রে নরেনের ঘরে জল রেখে আসবার সময় জানালা বন্ধ করতে গিয়ে সে দেখেছিল, ঠিক গেটের অল্পদূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে। এবং সে-ই আমাকে বলেছিল নম্বরটা—BLA 6786। তাই গাড়িতে পরিচিত নম্বরটা দেখে চমকে উঠেছিলাম সেরাত্রে। মধু এও আমাকে বলেছিল, সে নাকি ড্রাইভার নন্দুয়ার মুখে শুনেছে-প্রায়ই একটা গাড়িকে নিঃশব্দে নন্দুয়া তার প্রভুর গাড়িকে অনুসরণ করতে দেখেছে। আমার যা জানাবার বা বলবার জানালাম। এবং এইটুকু আমি নিশ্চয়ই করে বলতে পারি, নরেনের হত্যার জন্য। আমার মেয়ে কৃষ্ণা ও কাবেরী দায়ী নয়। এবং নরেনের মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চয় একটা রহস্য আছে। আপনার কাছে তাই শেষ প্রার্থনা অভাগিনী জননীর প্রতি অনুকম্পায় কৃষ্ণা ও কাবেরীকে এ হত্যার কলঙ্ক থেকে আপনি যেন বাঁচাবার চেষ্টা করেন। আর একটা কথা, নরেনের মৃত্যুর পর কৃষ্ণার সঙ্গে আমি দুচার দিন দেখা করেছি তাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে-বিনতার পরিচয়েই। সে আজও জানে না আমিই তার হতভাহিনী কলঙ্কিনী স্বামীপরিত্যক্তা জননী। তাদের চোখে আজ মৃতা হয়েও বেঁচে আছি। এবং দয়া করে একথা তাদের জানাবেন না। তারা যেমন জানে জননী তাদের মৃতা তাই যেন জানে। আমার কিছু অর্থ আছে ব্যাঙ্কে সঞ্চিত—সে টাকার জন্য আমি ব্যাঙ্কে আপনার নামে নির্দেশ দিয়ে গেলাম, আপনি টাকাটা তুলে কোন অবলা আশ্রমে দান করে দেবেন। আমাকে খোঁজবার চেষ্টা করবেন না, কারণ পৃথিবীতে কারো পক্ষে আমাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। নমস্কারান্তে–